গণমাধ্যম রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। একে বস্তুনিষ্ঠ, স্বচ্ছ, জবাবদিহি ও বিশ্বমানের করে গড়ে তোলার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের চাওয়া অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। স্বাধীনতার পর থেকে দেশের গণমাধ্যম নানান প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে রয়েছে। এখানকার গণমাধ্যম আর্থিক সংকট, গুণগত মান ও পেশাদারির দিক থেকে এখনো বিশ্বমানে উন্নীত হতে পারেনি, এটা অবশ্যই মানতে হবে। এ লক্ষ্যে সরকারের চাওয়ার সঙ্গে কারও কোনো দ্বিমত নেই। বরং সরকারের সৎ চাওয়ার প্রতিফলন হিসেবে প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পরই ড. মুহাম্মদ ইউনূস এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন দেখে গণমাধ্যমকর্মীরা খুবই আশাবাদী এবং আনন্দিত।
এ লক্ষ্যে সরকার দেশের গণমাধ্যমকে পরিণত, আধুনিক ও উন্নত মানসম্পন্ন স্তরে নিয়ে যেতে একটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। ওই কমিশন সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কাছে গণমাধ্যম সংস্কারে যেসব সুপারিশ প্রস্তাবসহ প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, তা সবার দৃষ্টিগোচর হয়েছে। এর কিছু কিছু প্রস্তাব অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। তবে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, যেগুলো দেখে বা পর্যালোচনা করে আমরা অনেক ক্ষেত্রেই বিস্মিত, শঙ্কিত ও ভীতি অনুভব করছি। অনেক ক্ষেত্রে মনে হয়েছে, কমিশনের কিছু প্রস্তাব বাস্তবতাবিবর্জিত, দেশের প্রেক্ষাপটে অন্যায্য ও অপ্রাসঙ্গিক।
সময়ের সঙ্গে পারিপার্শ্বিকতার সার্বিক চিত্র বিবেচনা না করে এমনভাবে সুপারিশ করা হয়েছে যে বাংলাদেশটা একটি কাল্পনিক রাজ্য। তথ্যপ্রযুক্তি, ভার্চুয়ালজগৎ, এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে তারা এসব উপেক্ষা করে পড়ে আছে সেই ট্রিপিক্যাল ধ্যানধারণা নিয়ে। তাদের কিছু প্রস্তাব এমন যে এতে পুরো মিডিয়ায় ভাঙন ধরবে। হাজারো সংবাদকর্মী চাকরি হারাবেন। এক ঝটকায় বন্ধ হয়ে যাবে অসংখ্য গণমাধ্যম।
উদ্যোক্তারাও হতাশ ও মর্মাহত। অর্থনৈতিক এ বিপর্যস্ত সময়ে লোকসানি গণমাধ্যম টেনে নিয়ে যাওয়া ‘ক্লান্ত’ উদ্যোক্তারা সব বন্ধ করে দিয়ে পালানোর পথ খুঁজবেন! কমিশনের প্রতিবেদন দেখে এমনও মনে হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে এটি তৈরির পেছনে একটি স্বার্থান্বেষী চক্র কলকাঠি নাড়ছে। বিশেষ করে প্রথম আলো-ডেইলি স্টার চক্রের হাত থাকা অস্বাভাবিক নয়।
কারণ যিনি কমিশনপ্রধান হয়েছেন, তিনি ওই চক্রের গণমাধ্যমে বিশেষ করে প্রথম আলোর বেতনভোগী সাবেক কর্মী। ওই প্রতিষ্ঠানের ‘নুন খাওয়া’ ব্যক্তি কোনোভাবেই মুক্ত ও নিরপেক্ষভাবে প্রস্তাব দিতে পারেন না। তিনি ওই প্রতিষ্ঠানের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই অনেক প্রস্তাব দিয়েছেন বলে আমাদের মনে হয়েছে। যেমন ঢাকা শহরে কোন পত্রিকা কত কপি চলে তা যাচাই করার জন্য কমিশন সংবাদপত্র হকার্স কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড এবং ঢাকা সংবাদপত্র হকার্স বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেডের কাছ থেকে ৭ অক্টোবর, ২০২৪ এবং ৯ নভেম্বরের তথ্য সংগ্রহ করে। দুই সমিতির দুই দিনের তথ্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম আলো শীর্ষে আছে বলে কমিশন রিপোর্টে উল্লেখ করে। অথচ পত্রপত্রিকা বিতরণকারী সমিতি নামে আরও একটি সমিতি আছে। সেই সমিতির তথ্য কমিশন সংগ্রহ করেনি। এর কারণ পত্রপত্রিকা বিতরণকারী সমিতি গড়ে প্রতিদিন ২৫০ কপি প্রথম আলো ঢাকায় বিতরণ করে। অন্যদিকে এ সমিতি গত ১৫ বছর টানা শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ প্রতিদিন গড়ে ৩৬ হাজার কপি ঢাকা শহরে বিতরণ করে। প্রকৃত তথ্য গোপন করে প্রচারসংখ্যায় প্রথম আলোকে শীর্ষে দেখানোর জন্যই একটি সমিতির হিসাব সংগ্রহ করা হয়নি। কমিশনের প্রধান সত্যিকার অর্থেই প্রথম আলোর নুন খাওয়ার প্রতিদান দিয়েছেন।
কমিশনপ্রধান জীবনের দীর্ঘ সময় ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিতে কাজ করেছেন। একটি উন্নত দেশে থেকে, মোটা অঙ্কের বেতন-ভাতা ও উন্নত জীবনে অভ্যস্ত। বাংলাদেশের তৃণমূল, এখানের আর্থসামাজিক অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ জনবিচ্ছিন্ন হয়ে তাঁর পক্ষে একটি স্বল্পোন্নত ও গরিব দেশের গণমাধ্যমের ‘আঁতুড়ঘর’ সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা পাওয়া অসম্ভব। অনেকটা ‘বেড়াতে এসে’ সবক দেওয়ার মতো অবস্থা!
তিনি তো সারা জীবন বিলাতি জীবনে অভ্যস্ত থাকা মানুষ! বাংলাদেশে কী কঠিন ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে একজন মানুষ সংবাদকর্মী হয়ে ওঠেন তার কতটুকু তিনি জানেন? স্থানীয় পর্যায়ে একটি পত্রিকা কীভাবে তৈরি হয়, সেখানের উদ্যোক্তা-কর্মীরা কতটা কঠিন সংগ্রাম করে একটি পত্রিকা টিকিয়ে রাখেন, তিনি তার সামান্যই হয়তো জানেন! ফলে তাঁর হাত দিয়ে যে সুপারিশমালা উঠে এসেছে, তার সঙ্গে বাস্তবতার মেলবন্ধন ঘটানো কঠিন।
যেমন তাঁর কমিশন ‘ওয়ান মিডিয়া, ওয়ান হাউস’ ধারণা বাস্তবায়নের কথা বলেছে। এ ধরনের চিন্তা সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাচারমূলক, অন্যায্য ও আপত্তিজনক। একটি স্বাধীন দেশে একক মালিকানায় কতটি গণমাধ্যম থাকতে পারবে কি পারবে না, তা ব্যক্তিস্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো। কারণ গণমাধ্যম একটি উদ্যোগ। এর পেছনে বিপুল অঙ্কের অর্থ লগ্নি করতে হয়। বিপরীতে এর আয় সীমিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অলাভজনক ও লোকসান গুনতে হয়। একজন উদ্যোক্তা বলতে গেলে তাঁর অর্থ ‘জলে ঢালা’র মতো মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই একটি গণমাধমে বিনিয়োগ করেন। এটি করে তাঁর সৃজনশীলতা, কর্মীদের মধ্যে উদ্যম ও উদ্দীপনা জাগিয়ে, প্রতিযোগিতামূলক সুযোগসুবিধা দিয়ে যখন ওই উদ্যোগটি এগিয়ে নিয়ে যান, সেটি টিকে থাকে পাঠকের গ্রহণযোগ্যতায়। এ প্রতিযোগিতামূলক সময়ে পাঠক না গ্রহণ করলে গণমাধ্যম টিকবে না।
গণমাধ্যমটি থাকবে কি থাকবে না তা একমাত্র পাঠক বা দর্শকই ঠিক করবেন। আর লোকসানি প্রতিষ্ঠান তিনি লোকসান দিয়ে চালাবেন কি না এটা তাঁরই বিষয়। কারণ তিনি তো কারও কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছেন না। একসময় যখন লোকসান আর টেনে নিতে পারবেন না, তখন তা বন্ধ করতেই হবে। এটাই তো বৈজ্ঞানিকভাবে স্বতঃসিদ্ধ ও যৌক্তিক।
আর কোনো গণমাধ্যম আইনের ব্যত্যয় ঘটাচ্ছে কি না তা দেখার জন্য তো গণমাধ্যম আইন ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা রয়েছে। এটা নতুন কিছু নয়। তাদের তদারকি নিশ্চিত করলেই তো আইনের ব্যত্যয় ঘটানোর দায়ে ওই গণমাধ্যমকে শায়েস্তা করা যায়। বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সেটা না করে ‘ওয়ান মিডিয়া, ওয়ান হাউস’ ধরনের স্লোগানে ‘টার্গেট’ করে এক গ্রুপের একাধিক মিডিয়া বন্ধের যে দুরভিসন্ধি, এটা কমিশনের কার্যক্রমে সুস্পষ্ট হয়েছে।
কমিশন এমনভাবে বলছে যেন বসুন্ধরা গ্রুপের মালিকানাধীন ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপের প্রথম সারির কয়েকটি মিডিয়াকে ‘ঘায়েল’ করাই মূল লক্ষ্য! দেশের অন্যতম শীর্ষ ও বৃহৎ পাঠকভিত্তির এ গ্রুপের অনেক গণমাধ্যম সফলতার সঙ্গে দেশের মানুষের ভালোবাসা অর্জন করেছে। এ মিডিয়া গ্রুপের সবকটি প্রতিষ্ঠানে সময়মতো কর্মীদের বেতন-ভাতা দেওয়া হয়। এখানে বিপুলসংখ্যক কর্মীর কর্মসংস্থান হয়েছে। কমিশনপ্রধানের ‘নুন খাওয়া’ প্রতিষ্ঠানের পছন্দ নয় বলে ওই গ্রুপের মিডিয়া বন্ধের এ হটকারী প্রস্তাব দেওয়া মানে দেশের মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংসের পাঁয়তারা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কমিশনের প্রস্তাবে এক গ্রুপের একাধিক মিডিয়া বন্ধের এই যে চক্রান্ত, তা গণমাধ্যমে শৃঙ্খলা ফেরানো বা বস্তুনিষ্ঠ গণমাধ্যম তৈরির লক্ষ্য নয়; বরং হাতে ধরে মিডিয়া বন্ধের নীলনকশা। হাজার হাজার সংবাদকর্মীকে বেকার করে তাদের পথে বসানোর ষড়যন্ত্র। প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সঙ্গে কমিশনপ্রধানের সংযোগ বিবেচনায় নিলেই এ দুরভিসন্ধি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কমিশন কি জানে না বিশ্বে হাজারো উদাহরণ রয়েছে একক গ্রুপে একাধিক মিডিয়ার? মিডিয়া টিকে থাকার মাধ্যম হচ্ছে প্রতিযোগিতা। জোর করে মিডিয়া বন্ধের ‘প্রেসক্রিপশন’ ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া আর কিছুই নয়। একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে এ ধরনের প্রস্তাব আমরা কোনোভাবেই মানতে পারছি না।
যদি একটি গ্রুপের একটি রেখে আর সব মিডিয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়, ওই মিডিয়াটি কে কিনবে? এত বিপুল অঙ্কের অর্থ কে লগ্নি করবে? সরকার কি কিনবে? এজন্য সরকার বাজেট দেবে? কত দেবে? তার কোনো প্রক্ষেপণ কি করেছে কমিশন? জনগণের ট্যাক্সের টাকা কতটা গ্রুপকে দেবে, কতটা মিডিয়া বন্ধ করতে হবে তিনি হিসাব করেছেন? এজন্য সরকারকে কত টাকা বরাদ্দ রাখতে হবে তাদের ধারণা আছে?
সরকারি টাকায় পরিচালিত বাসসসহ তিনটি প্রতিষ্ঠানকে তিনি একটি হিসেবে ‘মার্জ’ করতে বলেছেন। সরকারের বিপুল অঙ্কের টাকা নিয়েও ওইসব প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন হতে পারেনি। সরকারের পুরো নিয়ন্ত্রণে থাকার পরও ওইসব মিডিয়া লোকসানি। ওইগুলোও মানের দিক থেকে বেসরকারি খাতের মিডিয়া থেকে পেছনের সারিতে। তাদের কীভাবে বিশ্বমানের করা যায়, সে নীতি-কৌশল, কর্মপরিকল্পনা না করে, সময়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপায় না বের করে, মার্জ বা বন্ধ করে দেওয়ার সহজ পরামর্শ প্রদান মানে প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা আর হাজারো কর্মীকে পথে বসিয়ে দেওয়া ছাড়া কিছুই নয়।
আর কমিশন গণমাধ্যমকে অন্য ব্যবসার সঙ্গে তুলনা করে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির কথা বলেছে। অন্য ব্যবসার মূল লক্ষ্যই থাকে লাভ বা মুনাফা। আর গণমাধ্যমের মূল লক্ষ্য সেবা। চাওয়ার মধ্যেই বিস্তর তফাত। একটি লাভজনক ব্যবসা হিসেবে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি যৌক্তিক। কিন্তু সেবাধর্মী এবং বলতে গেলে জেনেশুনে অলাভজনক প্রতিষ্ঠান গণমাধ্যমকে পুঁজিবাজারে আনার প্রস্তাবও অবাস্তব।
কারণ দেশের পুঁজিবাজার সবচেয়ে নাজুক অবস্থায় রয়েছে। দেশের লাভজনক হাজারো প্রতিষ্ঠান এখনো সেখানে তালিকাভুক্ত হয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠানও বহু বলার পরও সেখানে যায়নি। এ বাজারে ফড়িয়া, দালাল, সিন্ডিকেটের যে দৌরাত্ম্য, তা পুঁজিবাজারকে ভঙ্গুর অবস্থায় নিয়ে ঠেকিয়েছে। এমন একটি বাজারে মিডিয়ার মতো স্পর্শকাতর একটি উদ্যোগকে নিয়ে গিয়ে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের নিঃস্ব করার আরেকটি চক্রান্ত। এতে মিডিয়াটিও নির্মূল হয়ে যাবে, বিনিয়োগকারীরাও পথে বসবেন।
আরেক প্রস্তাবে সাংবাদিকদের শিক্ষাগত যোগ্যতার যে কথা বলা হয়েছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সাংবাদিকদের সারা দেশে একই বেতন স্কেল হবে। যোগদানের প্রথমেই বিসিএসের নবম গ্রেডের কর্মকর্তাদের মতো হবে বেতন স্কেল। এটিও অবৈজ্ঞানিক সুপারিশ। সারা দেশের সংবাদকর্মীরা কীভাবে প্রধান কার্যালয়ের সংবাদকর্মীর সমমানের হবেন? প্রধান কার্যালয়ে প্রতিযোগিতামূলকভাবে একেকজন নিয়োগ পান। তাদের শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতা প্রতিযোগিতামূলক। একেক বিষয়ে একেকজন সাংবাদিকের অভিনবত্ব, সংবাদের ‘সোর্সের’ সঙ্গে গভীর সম্পর্ক, পেশাদারি-এ সবই একজন সাংবাদিকের মূল শক্তি। তার চাহিদাও বেশি। এটা সর্বত্র এক নয়, সম্ভবও নয়। এ ধরনের সাংবাদিকের সুযোগসুবিধা প্রতিযোগিতামূলক।
আর ঢাকার বাইরে যারা কাজ করেন, তারা নিজেদের আবাসস্থলের পাশে অন্য কোনো পেশায় থেকে এ পেশায় কন্ট্রিবিউট করেন। এটাই বাস্তবতা। চাইলেই রাতারাতি তাদের প্রধান কার্যালয়ের সমমানের ও মর্যাদায় উন্নীত করা অবাস্তব। পেশাদারি ও দক্ষতার বিবেচনায় কেন্দ্রের সঙ্গে প্রত্যন্তের কর্মীদের সমান কাতারে আনা দীর্ঘ সময় ও প্রক্রিয়ার বিষয়।
এটা কমিশন বললেই আর একটি পরিপত্র জারি করলেই বাস্তবায়ন হয়ে যাওয়ার কোনো পরিস্থিতি নেই। এতেই বোঝা যায় কমিশনপ্রধান বিদেশে থেকে দেশের বাস্তবতা না বুঝেই, কাল্পনিক এমন হটকারী প্রস্তাব দিয়েছেন। এমন প্রস্তাব দেশের একটি হাউসও বাস্তবায়ন করতে পারবে কি না সন্দেহ রয়েছে।
গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে সাংবাদিকদের মধ্যেও এরই মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বেশির ভাগই বলেছেন, কমিশনের প্রতিবেদনে কিছু উদ্ভট প্রস্তাব রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, কে সাংবাদিক হতে পারবে, কে পারবে না তা নিয়ে বিতকের্র কিছু নেই। সম্পাদক হওয়ার ক্ষেত্রে এ নিয়ম আগেই ছিল। প্রশ্ন হলো, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে এ সিদ্ধান্ত কি কার্যকর করা যাবে? অনেকেই হয়তো বলবেন, একজন আরজ আলী মাতুব্বর বা মোনাজাতউদ্দিন কি সার্টিফিকেট দিয়ে তৈরি হবে? তারা তৈরি হয় সাংবাদিকতার প্রতি তাদের মনপ্রাণ উজাড় করা অপ্রতিরোধ্য অসাধারণ জীবনীশক্তিতে ভর করে। একটি সার্টিফিকেট কি এক ‘অরাজক’ এবং ‘বিশৃঙ্খল’ অবস্থা থেকে সংবাদমাধ্যমকে মুক্ত করতে পারবে?
দেশের অর্থনীতি ও ব্যবসাবাণিজ্য একটি ক্রান্তিকাল পার করছে। লাভজনক ব্যবসাই এখন লোকসান গুনছে। টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ছে। একের পর এক কারখানা বন্ধ হচ্ছে। লাখ লাখ লোক চাকরি হারাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে লোকসান জেনেও গণমাধ্যম সাংবাদিকদের বেতন দিয়েও দেশের সেবা করে যাচ্ছে। পুরোনোটা চালাতেই হিমশিম অবস্থা। কেউ নতুন বিনিয়োগেও আসছে না।
এখন ডিজিটাল যুগ চলছে। প্রিন্টমাধ্যম প্রায় বসে যাওয়ার পথে। প্রযুক্তিই ঠিক করছে কে টিকবে আর কে টিকবে না। এখন একজন ব্যক্তিও একটি মিডিয়া বা প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠছেন। সেসব মিডিয়ার জন্য নীতিমালা দরকার। সোশ্যাল মিডিয়াই এখন বড় প্রতিষ্ঠানে রূপ নিচ্ছে। বিজ্ঞাপন বাজারও সেদিকে চলে যাচ্ছে। এটির সর্বোত্তম ব্যবহার কীভাবে হবে, ডিজিটালের সঙ্গে তৈরি হওয়া চ্যালেঞ্জ কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে দরকার সে কৌশল। কমিশনকে উত্তর আধুনিকতা বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার আয়ত্তে আনতে অভিনব বা সৃজনশীল কোনো প্রস্তাব দিতে দেখা যায়নি। তারা অনেকটা পুরোনো কাসুন্দিই ঘেঁটেছেন!
উদ্যোগটা যেখানে সম্পূর্ণ ব্যক্তিমালিকানাধীন, সেখানে বাস্তব অস্বীকার করে কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার অর্থ হবে ছোট ছোট সংবাদমাধ্যমকে গলা টিপে হত্যা করা। পেশাটিকে কীভাবে সহযোগিতা করে পেশাদার সাংবাদিক তৈরি করা যায়, কীভাবে একটি মানসম্পন্ন মিডিয়া তৈরি করা যায়, কোন পদ্ধতি অবলম্বন করলে বিদ্যমান একটি মিডিয়া হাউস আরও দক্ষ ও পেশাদার হবে, বস্তুনিষ্ঠ ও সৎ সাংবাদিকতা করতে পারবে; তার জন্য সরকার কী করতে পারে, নিয়ন্ত্রকরা কী করতে পারেন প্রস্তাব হতে হবে এসব।
কেউ কেউ বলছেন, সংবাদমাধ্যমে বেতনকাঠামো কেন সরকার নির্ধারণ করবে? শুধু সরকারি বিজ্ঞাপনের সুযোগ নিয়েই কি এ সিদ্ধান্ত চাপানো হচ্ছে? সব গণমাধ্যম কি বৈষম্যহীনভাবে সরকারি বিজ্ঞাপন পায়? সেখানে কি স্বেচ্ছাচার, অনিয়ম নেই? আর কেবল সরকারি বিজ্ঞাপন দিয়েই কি একটা সংবাদপত্র টিকে থাকতে পারে? এগুলো নিয়ে বিস্তারিত পর্যালোচনা কমিশন করেছে বলে আমাদের মনে হয়নি। এমনকি ইস্ট ওয়েস্ট মিডিয়া গ্রুপ দেশের শীর্ষ মিডিয়া হাউস হওয়ার পরও তাদের কারও সঙ্গে আলাপ পর্যন্ত করেনি। এত বড় একটি মিডিয়া হাউস কীভাবে চলে, এটা জানতে না চাইলে কীভাবে এর ভিতরের সংগ্রামের কথা জানবেন? আর এভাবে একটি খি ত পর্যবেক্ষণ নিয়ে পুরো মিডিয়া জগতের সংস্কার হয়? এটা কি যৌক্তিক?
আমরা আশা করব দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে কমিশন সবার সঙ্গে আরও বৃহৎ পরিসরে কথা বলে, সার্বিক বিষয়টি পর্যালোচনা করে যা বাস্তবসম্মত, তা নিয়ে বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ করবে। মূলত একটি পেশাদার মিডিয়া হাউস তৈরি, বিজ্ঞাপনের বণ্টন বৈষম্যহীন করা, বিজ্ঞাপনের হার বাড়ানো, পেশাদার সাংবাদিক তৈরি, পেশার মান বাড়ানো, তাদের লেখনীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে সরকার ভর্তুকি বা বিশেষ বরাদ্দ দিতে পারে।
এখানে প্রতিযোগিতামূলক কৌশলও নিতে পারে। বরং এটিই হবে সাংবাদিকতা সত্যিকার অর্থে এগিয়ে নেওয়ার প্রকৃত উপায়। প্রধান উপদেষ্টা বিশ্বসেরা একজন সম্মাননীয় ব্যক্তি। তিনি দেশে গণতন্ত্র ও সুশাসন ফেরানোর দায়িত্ব পেয়েছেন। আমরা আশা করি, কমিশনের ভিতরে যে দুর্বলতাগুলো রয়েছে, সেগুলো তিনি নিজস্ব পর্যবেক্ষণে বিচার করে দেশের মিডিয়া বাঁচানোর পদক্ষেপ নেবেন। একমাত্র মিডিয়াই শত কষ্টের মধ্যেও এখনো সমানভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এ মিডিয়াই জুলাই অভ্যুত্থানে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ছাত্রদের সঙ্গে জীবন বাজি রেখে রাজপথে থেকে দায়িত্ব পালন করেছে। কোনো কোনো সংবাদকর্মী আন্দোলনে জীবন দিয়েছেন। জীবন-মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েও দায়িত্ব পালন করে গেছেন। নিজেদের দাবিদাওয়া নিয়ে অন্য সবার মতো প্রধান উপদেষ্টার পথ আগলে ধরেননি। আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখে তাঁরা সরকারের ভালো কাজে পাশে থেকে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু কমিশন মিডিয়া ধ্বংসের আকস্মিক ও হটকারী যেসব প্রস্তাব দিয়েছে, তাতে তাঁরা ক্ষুব্ধ, হতাশ ও বিস্মিত। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে গেলে তাঁদের চাকরি হারাতে হতে পারে, এ আশঙ্কায় তাঁরা ভীত। এমনটি হলে হাজারো সংবাদকর্মীর রাস্তায় নামা ছাড়া গতি থাকবে না। এটি তাঁদের সরকারের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত কি না এও ভেবে দেখা দরকার।