ড্রয়িংরুম বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম হলো টেলিভিশন। এ দেশে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর চালু হয় সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ‘বাংলাদেশ টেলিভিশন’ (বিটিভি)। তখন থেকে কমপক্ষে নব্বই দশকের প্রথম পর্যন্ত বাংলাদেশ টেলিভিশন ছিল বাংলাদেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল। সুখের কথা হলো, এ চ্যানেলটি তার জন্মলগ্ন থেকেই প্রমিত বাংলায় অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছিল এবং তা পরিবার নিয়ে ড্রয়িংরুমে বসে দর্শক পরম তৃপ্তি সহকারে উপভোগ করত। তখন বিটিভির প্রযোজকদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা সবাই প্রকৃত বাংলা সংস্কৃতির ধারক-বাহক ছিলেন। তাই বিটিভির অনুষ্ঠানে প্রমিত বাংলা ভাষার চর্চা ছিল অবধারিত। আর এ কারণেই তখনকার নির্মাতা ও তাদের নির্মিত নাটকগুলো এখনো দর্শকের মনে গেঁথে আছে। এসব নাটকে ব্যবহার করা হতো শুদ্ধ প্রমিত বাংলা ভাষা। অন্য অনুষ্ঠানগুলোতেও শুদ্ধ বাংলা ভাষার যথার্থ প্রয়োগ হতো। তাই বিটিভি মানেই ছিল একদিকে যেমন সুস্থ ও সুষ্ঠু বিনোদনের বাহন, অন্যদিকে ছিল প্রমিত বাংলা চর্চা ও পাঠের মূল কেন্দ্র। সেই অবস্থা এখন আর নেই। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের প্রথম বেসরকারি টিভি চ্যানেল চালু হয়। তখন থেকে এ দেশে আস্তে আস্তে স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দুঃখের বিষয় হলো- এসব চ্যানেলে প্রমিত শুদ্ধ বাংলা ভাষা ব্যবহারে দৈন্য দেখা যায়। অপমৃত্যু ঘটে নাটকে প্রমিত বাংলার। এর মূল কারণ হিসেবে সাংস্কৃতিকবোদ্ধাদের দাবি- আগের মতো জ্ঞানী ব্যক্তিদের বিচরণ কমে আসছে টিভি চ্যানেলগুলোতে। তাই নাটকসহ যে কোনো অনুষ্ঠানের ভাষা হয়ে যাচ্ছেতাই শ্রেণির। যা একটি নিজস্ব সংস্কৃতিসমৃদ্ধ জাতির কাছে কখনো কাম্য হতে পারে না। এখনকার প্রায় নাটকের সংলাপ ‘খাইসি, গেছি’ টাইপের হয়ে গেছে। আর এতে চরমভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে ড্রয়িংরুমে বসে পরিবার নিয়ে টিভি অনুষ্ঠান দেখা সুস্থ রুচির দর্শকরা।
প্রখ্যাত সাংবাদিক অনুপম হায়াৎ বলেন, মানছি যে আমরা দৈনন্দিন জীবনে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি, কিন্তু তাই বলে নাটকের ক্ষেত্রে এভাবে সংলাপ বললে কি সেটা শ্রুতিমধুর লাগে? আগে বিটিভিতে প্রচারিত নাটকের অভিনয় শিল্পীদের সংলাপ থেকে আমরা কথা বলার স্টাইল শিখতাম। কীভাবে শুদ্ধ বাংলা ভাষার প্রয়োগ করা যায়, কীভাবে প্রমিত উচ্চারণ করতে হয় এসব অনেক অনুকরণীয় ছিল। অতীতের নাটকের সংলাপ থেকে ভাষা শেখার অনেক বিষয়ই ছিল। কিন্তু এখনকার টিভির নাটক বা অন্য অনুষ্ঠানের শিল্পীদের সংলাপ থেকে আমরা কী শিখতে পারি? এসব সংলাপ শুনে আমাদের তরুণ প্রজন্ম কী শিখবে? আমাদের ঘরের ছোট ছেলেমেয়েরাই বা কী শিখবে? যেমন ‘আবার জিগায়, ফাঁপরের মধ্যে আছি, দৌড়ের মধ্যে আছি, পুরাই পাঙ্খা’- এসব ভাষা এখন বাচ্চারা শিখছে। এই যদি হয় টিভি নাটকের দশা তবে কার ভালো লাগবে টিভি নাটক দেখতে? টিভিতো আর ড্রয়িংরুমের পরিবার নিয়ে দেখার মাধ্যম রইল না। অনেকে বলছেন, ভাইরালের নেশা টিভিকেও পেয়ে বসেছে।
জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আবদুল্লাহ রানা বলেন, আগেকার নাটকে ছিল পারিবারিক বন্ধন, শালীন ভাষা ও সামাজিক শিক্ষা। সবকিছু মিলিয়ে নাটক হয়ে উঠেছিল জীবনেরই একটি অংশ। এখনকার অধিকাংশ নাটক হয়ে উঠেছে সস্তা বিনোদনের অনুষঙ্গ। সবাই যেন ছুটছে ভাইরালের নেশায়। যে ভাইরাস নাট্য ইন্ডাস্ট্রিতে তৈরি করেছে সামাজিক অবক্ষয়ের। যে অবক্ষয়ের মধ্যে আছে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয় দক্ষতার অভাব, অশালীন ভাষা, ভালো গল্পের অভাব ও বাজেটের স্বল্পতা। সবকিছু মিলিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে এ নাট্য ইন্ডাস্ট্রি। একটি নাটক বা অনুষ্ঠান দর্শকদের সামনে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে ভাষা। বিকৃতির বিষয়টি এখন ভাষায় আটকে নেই। এটি এখন কনটেন্টে আটকে আছে। ভাষার বিকৃতি এখন অনেকাংশে ভাঁড়ামির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। খুব কম নাটকেই দেখা যায় সঠিক বাংলা ভাষার ব্যবহার। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে শুদ্ধ ভাষাকে মিলিয়ে নতুন এক ধরনের ভাষা তৈরি করে কথা বলছে একটি দল। বাংলা নাটকের একটা সময় ছিল স্বর্ণালি যুগ। গল্পের গাঁথুনি কিংবা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়ের দক্ষতা দর্শকদের মুগ্ধ করত। যে নাটকগুলো এখনো দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটে আছে। তবে এখনকার অধিকাংশ নাটকই যেন সস্তা বিনোদন। ভাইরালের নেশা যেন সবাইকে পেয়ে বসেছে। দিনকে দিন কীভাবে হলো বাংলা নাটকের এ হাল। তা নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আবদুল্লাহ রানা। নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর হাত ধরে নাটকে অশ্লীল ভাষা শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি। একটি নাটক দর্শকদের সামনে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলে নাটকের ভাষা। নাটকের ভাষার বিকৃতি প্রসঙ্গে অনেকেই আঙুল তোলেন নির্মাতা কাজল আরেফিন অমির দিকে। তবে অভিনেতা আবদুল্লাহ রানা সে আঙুল ঘুরিয়ে প্রশ্ন তুললেন আরেক পরিচালক মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর দিকে। ভাষা বিকৃতি ‘ব্যাচেলর পয়েন্ট’ নাটকে আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভাষার তেরোটা বাজানো মোস্তফা সরয়ার ফারুকী শুরু করেছিলেন। সেটির ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। ভাষা বিকৃতি করে ফারুকী জনপ্রিয় হয়েছিলেন। অমিও জনপ্রিয় হয়েছেন। বিষয়টি এখন ভাষায় আটকে নেই। এটি এখন কনটেন্টে আটকে আছে।
একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাটক নির্মাতা আবুল হায়াত বললেন, একটা সময় প্রমিত বাংলায় মানুষ কথা বলতেন। টিভি নাটক দেখে বাচ্চারা কথা বলা শিখবে, সে জায়গা থেকে আমরা নাটক করতাম। এখন নাটকের নাম শুনলেই মোটামুটি সব বোঝা যায়। আমরা এখন ভাঁড়ামি গেলাতে চাইছি। জানি না, কীভাবে বেরিয়ে আসা যাবে এখান থেকে। এখানে টেলিভিশন চ্যানেলের দায় অনেক। ‘এই শহরে’, ‘আমাদের সমাজবিজ্ঞান’, ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’, ‘মায়া সবার মতো না’, ‘কাঠপেন্সিলের কাহিনী’, ‘তুমি ফিরে আসোনি’, ‘আগন্তুক’, ‘ফেরা’, ‘শুনতে কি পাও’র মতো নামের নাটকও আছে। সেগুলোও দর্শকপ্রিয় নাটক। তবুও এখন ভিউয়ের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্য ভুলে যাচ্ছি।’
নির্মাতা ও অভিনেতা সালাহউদ্দীন লাভলু বলেন, ‘এখন নাটক চলে গেছে চ্যানেলের মার্কেটিং বিভাগ ও এজেন্সির হাতে। তারাই নাটকের গল্প ও শিল্পী নির্ধারণ করে দেয়। যার কারণে অনেক সময় নির্মাতারা নিজেদের পছন্দের গল্পে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। আবার এটিও সত্যি, এ সময়ের অনেক তারকা ভালো ভিউ হতে পারে এমন গল্পের নাটকগুলোতেই বেশি কাজ করছেন। যে নাটকের বেশি ভিউ হওয়ার সম্ভাবনা আছে সেটিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছেন। এর শিল্পমান কেমন হবে কিংবা দর্শকদের মনে দাগ কাটবে কিনা, তা তাদের কাছে বিবেচ্য নয়।’
এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রখ্যাত নাটক নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বলেন, ২৪ বছর ধরে নাটক নির্মাণ করছি। এক্ষেত্রে আমি বরাবরই প্রমিত বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রতি সচেতন থাকি। কারণ টেলিভিশন হচ্ছে পারিবারিক বিনোদন মাধ্যম। নাটকে যদি খাইছি, পাইছি, গেছি, ধরছি টাইপের অশুদ্ধ নিম্নমানের শব্দ ব্যবহার করা হয় তাহলে দর্শক বিশেষ করে বাচ্চারা কী শিখবে? কারণ ছোটবেলাটিই হচ্ছে শেখার প্রকৃত বয়স। যারা এ জাতীয় নিম্নরুচির শব্দ ও ভাষা নাটকে ব্যবহার করে তাদের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাই। গল্পের প্রয়োজনে নাটকে দু-একটি এমন শব্দ যেমন, কাজের মানুষের মুখে উচ্চারিত হয় তা ব্যবহার করা যেতেই পারে। তাই বলে ঢালাওভাবে অপ্রয়োজনে তা করা উচিত নয়। মজার ব্যাপার হলো যেসব নির্মাতা এমন বিকৃত ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করে তারাই আবার কোথাও ইন্টারভিউ দিতে গেলে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলেন। কারণ তারা জানে ওইসব ভাষা শালীন নয়। আরেকটি বিষয় হলো নাটকে গল্পের প্রয়োজনে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করা যেতেই পারে। তাই বলে এই ভাষাকে বিকৃতভাবে নাটকে উপস্থাপন করা কী জাতি হিসেবে আমাদের নৈতিকতা ও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে? এ প্রশ্ন তাদের কাছে রাখছি যারা এমন গর্হিত কাজ করে। আমরা কিন্তু বাসাতেও কাজের মানুষকে বাচ্চাদের সামনে শুদ্ধভাবে কথা বলতে বলি। কারণ বাচ্চারা ছোট বয়সে যা শুনে তাই শিখে। তাই স্বাধীন নাগরিক হিসেবে প্রত্যেককে বলব জাতি হিসেবে ভাষা ব্যবহারে আমাদের সচেতন হতে হবে। নাট্যবোদ্ধাদের মতে, নাটকে এখন প্রাধান্য পাচ্ছে ‘ভিউ’ নামক শব্দ। কারণ, যত ভিউ, তত টাকা। স্বাভাবিকভাবে ভিউকে টার্গেট করেই নির্মিত হয় নাটক। তবে ভিউ যখন লক্ষ্য হয়, তখন নাটক হয়ে যায় ‘কনটেন্ট’। বেশি ভিউয়ের আশায় প্রযোজক, নির্মাতা থেকে শুরু করে শিল্পীরাও এ ভার্চুয়াল লড়াইয়ে মত্ত। ভিউ বাড়াতে দেওয়া হচ্ছে নাটকগুলোর অদ্ভুত, অশ্লীল, চটকদার ও কুরুচিপূর্ণ নাম। যা আমাদের দেশের শিল্প সংস্কৃতিকে বিশ্বে অত্যন্ত অমর্যাদাকরভাবে তুলে ধরছে। ব্যবসায়িক দিক চিন্তা করে দিন দিন বাংলা নাটকের ঐতিহ্য বিলীনের পথে। এসব দেখার যেন কেউ নেই।