ভিন্ন ধর্মের দুটি মন যখন প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়ে তখন তার যবনিকা খুব একটা সুখকর হয় না। বিচ্ছেদের অনলে পুড়ে এমন অসম প্রেম। তারপরও প্রেম শাশ্বত। প্রেম মানে না জাত-কুল-ধর্ম। ভারতের চলচ্চিত্রের গল্পে এমন অসম প্রেমকাহিনি উঠে এসেছে বহুবার। তবে ঢাকায় ১৯৫৬ সালে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হলেও দুই ধর্মের দুটি মনের প্রেমের গল্প প্রথম দেখানো হয় ১৯৬৭ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ঐতিহাসিক গল্পের ‘নবাব সিরাজউদ্দৌলা’ চলচ্চিত্রে। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ভালোবেসে মোহাবিষ্ট হন হিন্দু নর্তকী আলেয়ার প্রতি। খান আতার এই ঐতিহাসিক চলচ্চিত্রেই প্রথম দুটি ভিন্ন ধর্মের ভালোবাসা দেখানো হয়। যদিও এর ঐতিহাসিক সত্যতা বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। তবে এই ধর্মীয় সংকটকে মুখ্য করে দারুণ সাড়া জাগায় কাজী জহির পরিচালিত ও রাজ্জাক-শাবানা অভিনীত ‘অবুঝ মন’ চলচ্চিত্রটি। ১৯৭২ সালে মুক্তি পাওয়া ‘অবুঝ মন’ এই ধারার চলচ্চিত্রের বিচারে এখানো সেরা।
ধর্মীয় সংকট নিয়ে প্রেমনির্ভর সিনেমা বেশি নির্মিত হতে থাকে নব্বই দশকের পর থেকে। একে একে নির্মিত হয় অবুঝ দুটি মন, দোলা, প্রেম পিয়াসী, আজ গায়ে হলুদ, প্রেমের তাজমহল, সবার উপরে প্রেম, ছোট্ট একটু ভালোবাসা, জীবনের চেয়ে দামি, ভুল, এই তো প্রেম, অন্তর্জ¡ালা, স্বপ্নজাল থেকে সর্বশেষ ফাগুন হাওয়ায়। এই সিনেমাগুলো মূলত প্রেমে ধর্মীয় সংকটের বিষয়টি দর্শকদের জানাতে নির্মাণ করেছেন নির্মাতারা।
ভারতে দ্বিপক্ষীয় দেখালেও আমাদের দেশের নির্মাতারা সব সময় একপক্ষীয় থেকে গেছেন, কিংবা বলা যায়, সেভাবে ঝুঁকি নিতে চাননি। যেমন- প্রায় প্রতিটি চলচ্চিত্রেই নায়ক মুসলিম থাকেন এবং নায়িকা অন্য ধর্মের। পুরো সিনেমাতেই নির্মাতা দেখান মানব ধর্মই আসল ধর্ম, নায়ক-নায়িকারা রক্ত বের করে মিলিয়ে দিয়েছেন। তবু শেষে তাদের সফল পরিণতি ঘটাননি। সেখানে দেখানো হয়েছে নায়ক-নায়িকা মারা গেছেন কিংবা নায়িকাকে নিজ ধর্মের কারও সঙ্গেই অন্যত্র বিয়ে দেওয়া হয়েছে। ‘অবুঝ মন’কে অনুসরণ করেই নির্মিত হয়েছে ‘আজ গায়ে হলুদ’ ও ‘সবার উপরে প্রেম’। অন্যদিকে ‘অবুঝ দুটি মন’কে অনুসরণ করেছে দোলা, প্রেম পিয়াসী ছবিগুলো। ধর্মীয় সংকট নিয়ে প্রেমনির্ভর ছবিতে অনন্য হতে পারত রিয়াজ-শাবনূরের ‘প্রেমের তাজমহল’, কিন্তু শেষে এসে চিত্রনাট্যে জোরপূর্বক নায়িকার জন্ম পরিচয় এনে সিনেমাটির শিল্প মান নষ্ট করেছে বলে মনে হয়েছে, একই কথা ‘জীবনের চেয়ে দামী’ সিনেমার বেলায়ও। তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রিয়াজ-পূর্ণিমার ‘ছোট্ট একটু ভালোবাসা’। ‘ডাক্তার বাড়ি’ ছবিতেও শাবনাজ-অমিতের বিয়ে হয়, তবে গল্পে সেই বিষয় মুখ্য ছিল না। প্রথমটিতে সমাজ ও পরিবারের বাধা পেরিয়ে তারা অজানা গন্তব্যে বের হয়। আর ‘ডাক্তার বাড়ি’তে আন্তঃধর্মীয় প্রেমের বিষয়টি এলেও নায়িকা বিয়ের মাধ্যমে নায়কের বাড়িতে স্থান পায়। যদিও এ সংক্রান্ত কোনো সংকট সিনেমায় প্রাধান্য পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা ‘এই তো প্রেম’ কিংবা তানভীর মোকাম্মেলের ‘চিত্রা নদীর পাড়ে’ সিনেমাতেও এই একইভাবে ধর্মীয় দিকটি ফুটে উঠেছে। ‘স্বপ্নজাল’ যখন বানানো হলো, তখন আশা করা হয়েছিল অন্তত গিয়াসউদ্দিন সেলিম এই চিরাচরিত ধারা ভাঙবেন, কিন্তু না তিনিও ঝুঁঁকি নিতে চাইলেন না। সর্বশেষ ভাষা আন্দোলন ও প্রেমনির্ভর ‘ফাগুন হাওয়ায়’ সিনেমাতেও নায়ক মুসলিম ও নায়িকা অন্য ধর্মের। তবে গল্পে ধর্মীয় সংকট স্থান পায়নি। আর সমাপ্তিও ছিল ইতিবাচক। তৌকীর আহমেদের প্রথম সিনেমা ‘জয়যাত্রা’য় ছোট পরিসরে দেখানো হয়েছিল খ্রিস্টান যুবক ইন্তেখাব দিনার প্রেমে পড়েছিলেন মুসলিমকন্যা চাঁদনীর, অবশ্য তাদেরও মিল হয়নি। সেখানে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ব্যতিক্রম কিছু দেখালেন নির্মাতা। ভবিষ্যতে বাংলা সিনেমায় এই ধর্মীয় সংকটের চিরাচরিত গণ্ডি ভেঙে প্রেমের মিলনকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হবে-এমনটাই দর্শকদের প্রত্যাশা।