দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়ে অগ্রগতি এবং জ্ঞানান্বেষণে সন্তোষের অনুপস্থিতি। এরা একসঙ্গে চলে; কিন্তু তাদের চলার পথে প্রতিবন্ধক থাকে। কারা এই প্রতিবন্ধক তৈরি করে? করে কায়েমি স্বার্থ। যে স্বার্থ প্রতিষ্ঠিত হয়ে রয়েছে সেটি নানাভাবে দ্বন্দ্বের বিকাশ ও জ্ঞানের অগ্রগতিতে বাধা দেয়, সামনাসামনি দাঁড়ায়, আবার গোপনেও তৎপরতা চালায়। এককালে রাজা ছিল। রাজা চেয়েছে প্রজারা চিন্তাশক্তিবিবর্জিত হোক, তারা কেবল মান্য করে চলুক। প্রজারা চিন্তা করলেই নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে অসন্তুষ্ট হবে, হয়তো বিদ্রোহ করবে, রাজার সঙ্গে প্রজার দ্বন্দ্ব দেখা দেবে। একসময় রাজতন্ত্র চলে গেছে। তার জায়গায় নতুন ধরনের রাষ্ট্র এসেছে, এসেছে রাষ্ট্রের কর্তারা। তারা নিজস্ব ব্যবস্থা কায়েম করেছে। তাদের নতুন ব্যবস্থাও পুরান ব্যবস্থার মতোই দার্শনিক চিন্তার অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। কায়েমি স্বার্থ ধর্মকে কাজে লাগায়। রাজারা বলেছে, তারা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা নিয়ে এসেছে, তাই প্রজাদের কর্তব্য তাদের নীরবে মান্য করা। এ কাজে তারা সমর্থন পেয়েছে পুরোহিততন্ত্রের। একই কারণে, উভয় পক্ষের বস্তুগত স্বার্থরক্ষার অভিপ্রায়ে। তাই দেখা যায়, দার্শনিকদের ভিতর যারা ইহজাগতিক, যাদের চিন্তা ক্ষমতাবানদের স্বার্থের জন্য প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থাকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়। তাদের নিরুৎসাহিত করা তো বটেই, কখনো বিষ খাইয়ে কখনো বা পুড়িয়ে, হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে।
মূল চরিত্রে সব শাসকই স্বেচ্ছাচারী ও স্বৈরাচারী। তারা সবাই ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে পবিত্র জ্ঞান করে, এবং তার মহিমা প্রচারের জন্য দর্শনকে ব্যবহার করে। বিজ্ঞানকেও তারা ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থরক্ষার কাজে। বিজ্ঞানের উদ্ভাবিত মাধ্যমগুলোর সাহায্যে তারা নিজেদের গৌরব প্রচার করে। সেই সঙ্গে তারা বৈজ্ঞানিক অস্ত্র ও কলাকৌশলের সাহায্যে বিক্ষোভ দমন এবং বিক্ষুব্ধ মানুষদের বিভক্ত ও বিভ্রান্ত করতে সচেষ্ট থাকে। বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়েই তারা উপনিবেশ গড়ে এবং সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটায়।
প্রতিষ্ঠিত স্বার্থ তার শাসন বজায় রাখার প্রয়োজনে মানুষের অগ্রগতি ও মুক্তির প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। ইহজাগতিক দর্শন ও বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সঙ্গে শত্রুতা করে। সভ্যতার অগ্রগতির ভিন্ন ভিন্ন স্তরে এই কায়েমি স্বার্থের নাম বদলেছে, চেহারা ও ভাবভঙ্গিতে পরিবর্তন এসেছে, কিন্তু তার স্বভাব বদলায়নি। আধুনিক যুগে মানুষের অগ্রগতির পথে যে বৈরী শক্তিটি প্রধান প্রতিবন্ধক, তার নাম পুঁজিবাদ। ওই নামে চিনলে তার আচার-আচরণের রূপ ও ধরন বুঝতে অসুবিধা থাকে না। পুঁজিবাদই এখন বিশ্বকে শাসন করছে। এটি একাধারে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং দার্শনিক আদর্শ। এই ব্যবস্থার রাজনৈতিক প্রকাশটি হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, যা এখন বিশ্বময় মানুষের এবং মনুষ্যত্বের ওপর নিষ্ঠুর নিপীড়ন ও শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এটি স্বীকৃত সত্য যে একসময় পুঁজিবাদের একটি প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল। সামন্তবাদের সংকীর্ণতার নিগড় থেকে উৎপাদনব্যবস্থা এবং মানুষকে সে মুক্তি দিয়েছিল। যার ফলে মানুষের চলাচল এবং চিন্তা ও কাজের জগৎ প্রসারিত হয়েছে। মানুষ আধুনিক হয়ে উঠেছে। এই আধুনিকতার দার্শনিক কাজটি ছিল ইহজাগতিকতার জন্য পথ তৈরি করে দেওয়া। ফলে মানুষ নিজেকে সব জাগতিক বিবেচনার কেন্দ্রস্থলে স্থাপন করবার সুযোগ পেয়েছে। সর্ববিধ অর্জনকে নিজের সন্তুষ্টির নিরিখে বিচার করার অধিকার অর্জন করেছে। এই যে বৈপ্লবিক অগ্রগতি তা কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পুরান আগ্রহটিকে নষ্ট করল না, বরঞ্চ তাকে আরও শক্তিশালী ও বিস্তৃত করে দিল। ফলে বৈষম্য যে কেবল টিকে রইল তাই নয়, বৃদ্ধি পেল। যারা ক্ষমতাবান সেই অল্পসংখ্যক মানুষের ধনবৃদ্ধির সঙ্গে সমমাত্রায় বিপুলসংখ্যক মানুষ দরিদ্রে পরিণত হলো, এবং সম্পত্তিহীনদের ওপর সম্পত্তিবানদের শাসন ও শোষণ অধিকতর দক্ষতা অর্জন করল।
পুঁজিবাদী দর্শনের মূল ভিত্তি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। পুঁজিবাদ ইহজাগতিক। কেবল ইহজাগতিক নয়, স্থূলরূপে বস্তুতান্ত্রিক। পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় অধিকাংশ মানুষই বঞ্চিত, যত সুখ বিত্তবানদের। ন্যায়বিচারসহ সব ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিতদের পক্ষে বিদ্রোহ করার কথা। ব্যাপার আরও আছে। পুঁজিবাদের প্রকৃত শত্রু সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা। সেই ব্যবস্থার পক্ষে দার্শনিক সমর্থন যাতে গড়ে না ওঠে তার জন্য পুঁজিবাদ সর্বপ্রকারের প্রচারকার্য চালায়, এবং সমাজবিপ্লবীদের সরাসরি দমন করে। এভাবে শান্ত রাখা এবং ভাগ্যপরিবর্তনের আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি যে অনৈতিক, পুঁজিবাদীরা সেটি ভাবতেও চায় না। আসলে পুঁজিবাদীদের ধার্মিকতা ও নৈতিকতা পুরোপুরি মনুষ্যত্ববিরোধী। এদের বস্তুতান্ত্রিকতাও মানুষের ইহজাগতিক অগ্রগতির শত্রুপক্ষ বৈ নয়। পুঁজিবাদীরা ধার্মিক-অধার্মিকের, নাস্তিক-অনাস্তিকের ব্যবধান তৈরি করে তাদের প্রতিষ্ঠিত শোষণ ব্যবস্থাকে আড়াল করে দেয়। সাম্প্রদায়িকতাও তৈরি করে। একদা এই উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসক এবং জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ, তিন পক্ষই ছিল পুঁজিবাদে দীক্ষিত। তারা নিজ নিজ স্বার্থে ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইটাকে সাম্প্রদায়িক বিরোধে পরিণত করেছে এবং উনিশ শ সাতচল্লিশ সালে মানুষকে স্বাধীনতার নামে দেশভাগের মারাত্মক ও নিষ্ঠুর উপহারটি দান করে গেছে। যার অভিশাপ থেকে এখানকার মানুষ এখনো মুক্ত হতে পারেনি।
ব্যক্তিগত সম্পত্তির সংরক্ষণ ও উন্নয়নকে কেন্দ্রে রেখে আবর্তিত পুঁজিবাদী দার্শনিকতার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বৈষয়িক মুনাফা অর্জনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া।
মুনাফা বৃদ্ধির লালসা একটি ভয়ংকর ব্যাপার। এর ফলে বিশ্বে দুই দুটি মহাযুদ্ধ ঘটে গেছে। এবং এখনো পৃথিবীর অনেকাংশে সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য, নির্যাতন ও শোষণ কায়েম রয়েছে। মুনাফা আসে বাণিজ্য, জবরদখল, পুঁজি বিনিয়োগ ও লুণ্ঠনের মধ্য দিয়ে। এক অর্থে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক তৎপরতার সবটাই অবশ্য লুণ্ঠনের ভিতর পড়ে। এই ব্যবস্থা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক ও ভোগবাদী হতে উৎসাহ দেয়। মানুষ অসামাজিক, পরস্পরবিচ্ছিন্ন, এমনকি নিজের থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পুঁজিবাদ মানুষে মানুষে বৈষম্য তৈরি করে। যদিও সে গণতন্ত্রের মহিমা প্রচারে আগ্রহী, কিন্তু চরিত্রগতভাবেই পুঁজিবাদ অগণতান্ত্রিক। কেননা গণতন্ত্রের মূল ভিত্তিই হচ্ছে মানুষের সঙ্গে মানুষের অধিকার ও সুযোগের সাম্য নিশ্চিতকরণ, পুঁজিবাদ যার বিরুদ্ধে সর্বদাই দণ্ডায়মান।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনায় উন্নয়ন ঘটে বৈকি, কিন্তু সেটি খাড়াখাড়ি ওপরের দিকে উঠে যায়, অনেকটা পিরামিডের মতো। এই উন্নয়ন সামাজিক নদীর মতো প্রবাহিত হয় না, প্রবাহিত হলে সমাজের সব মানুষের জীবনকে সে সুখী করতে পারত। উল্টো যা ঘটে তা হলো উন্নতি সমাজের অধিকাংশ মানুষের কাঁধের ওপর ভর করে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। যত ওঠে তত সে যন্ত্রণাদায়ক হয় ভারবাহী মানুষদের জন্য। এ এক আধুনিক রূপকথা। উল্লেখ্য ঐতিহাসিকভাবেই পুঁজিবাদ পুরুষতান্ত্রিক, যেজন্য তার অধীনে নারীর নিগ্রহ ও অবমূল্যায়ন অবশ্যম্ভাবী।
এ বিষয়ে তো কোনো সন্দেহই নেই যে আমাদের দেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং তার সংরক্ষক ও সুবিধাভোগী শ্রেণির মতাদর্শিক আধিপত্য বিরাজ করছে। উন্নতি হচ্ছে, তবে তার সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে বৃদ্ধি পাচ্ছে বৈষম্য। পরাধীনতার কালে আমাদের মুক্তিসংগ্রামে দেশপ্রেম ছিল বড় ভরসা। এখন দৃষ্টি পুঁজিবাদী বিশ্বের দিকে। ফলে পুঁজি, সম্পদ, মেধা সবকিছুই পাচার হয়ে যাচ্ছে। আমরা বিদেশি পণ্যের বাজারে পরিণত হচ্ছি। উৎপাদন খাতের তুলনায় সেবা খাত প্রসারিত হচ্ছে। যে কৃষক দেশবাসীকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাঁরা ভূমির মালিকানা হারিয়ে পরিণত হচ্ছেন খেতমজুরে। শহর গ্রামকে নিঃস্ব করছে।
গ্রামে কর্মসংস্থান নেই, ভরসাহীন মানুষেরা শহরে ছুটছে। শহরে তারা উপযুক্ত কাজ পাচ্ছে না, অর্ধবেকার থাকছে, আবাস খুঁজছে বস্তিতে। বিনিয়োগ অল্প, অলস টাকা পড়ে থাকছে ব্যাংকে। ব্যাংক ডাকাতি এখন আর বাইরে থেকে নয়, ভিতর থেকেই ঘটে। মেয়েরা এগিয়েছে, কিন্তু তাদের নিরাপত্তা বাড়েনি। যে পোশাকশিল্প নিয়ে আমাদের অত্যন্ত গর্ব, সেটিও দাঁড়িয়ে আছে সস্তা শ্রমের নড়বড়ে ও বিপজ্জনক ভিত্তির ওপরে।
লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়