সারাদেশে ৫ কোটি শিশুকে টার্গেট করে আজ পর্যন্ত ৩৮ লাখ শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত এ কার্যক্রম চলবে।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর এ কথা জানান।
মহাপরিচালক আরও জানান, বিশ্বের টাইফয়েড প্রাদুর্ভাব অঞ্চলে বাংলাদেশের অবস্থান। মূলত দূষিত পানি, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার অভাব এবং খাবারের মাধ্যমে টাইফয়েড ছড়িয়ে থাকে। শিশুদের টাইফয়েড থেকে রক্ষা করতে হলে টিকা দেয়া খুবই জরুরি।
তিনি বলেন, টাইফয়েডের টিকা দেয়া হলে বাচ্চারা কমপক্ষে পাঁচ বছর পর্যন্ত টাইফয়েড এর জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে।
মহাপরিচালক বলেন, টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন-২০২৫ বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিশেষ পদক্ষেপ। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অধীন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই) ১৯৭৯ সাল থেকে প্রতিরোধযোগ্য বিভিন্ন সংক্রামক রোগজনিত মৃত্যু ও পঙ্গুত্বের হার কমিয়ে আনার লক্ষ্যে সারা দেশে টিকাদান কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে টিকা দিয়ে প্রতিরোধযোগ্য মারাত্মক সংক্রামক রোগগুলোর মধ্যে টাইফয়েড জ্বর অন্যতম। 'সালমোনেলা টাইফি'নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে এই রোগ হয়ে থাক। সারা দেশে ৯ থেকে ১৫ বছর বয়সী পাঁচ কোটি শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে ১২ অক্টোবর, চলবে ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত।
তিনি বলেন, আজ বুধবার পর্যন্ত সারা দেশে ৩৮ লাখ ৩৭ হাজার ৬১২ শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী রয়েছে ৩৫ লাখ ১৫ হাজার ৪৩ জন। আর বিভিন্ন কমিউনিটি ক্লিনিকে দেওয়া হয়েছে ৩ লাখ ২২ হাজার ৫৬৯ জনকে।
তিনি বলেন, স্কুলের নবম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা টাইফয়েডের টিকা গ্রহণ করতে পারবে। এজন্য সারাদেশে রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াও টিকাদান কেন্দ্রে কেউ উপস্থিত হলে সে টিকা নিতে পারবে। নয় মাস থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত সকল শিশুর টিকা নিতে কোন বাধা নেই।
মহাপরিচালক বলেন, এক সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ সালে বিশ্বে ৭০ লক্ষের বেশি মানুষ টাইফয়েড রোগে আক্রান্ত হয় এবং তার মাঝে প্রায় ৯৩ হাজার লোক মৃত্যুবরণ করে। যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দক্ষিণ এশিয়ায়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সি শিশুরাই টাইফয়েড জ্বরে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে। স্বাস্থ্য বিষয়ক গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিজ স্টাডি-এর সমীক্ষা অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার মানুষ টাইফয়েড জ্বরে মৃত্যুবরণ করে যার মধ্যে ৬৮% অর্থাৎ প্রায় ৬ হাজার ১৫ বছরের কম বয়সি শিশু। উপরন্তু বর্তমানে বৈশ্বিক এক স্বাস্থ্যঝুঁকি আর উদ্বেগের নাম ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড।
আবু জাফর বলেন, টাইফয়েড জ্বরের চিকিৎসায় প্রচলিত যেসব এন্টিবায়েটিক ব্যবহার হয় তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বর্তমান টাইফয়েড নিরাময়ে কাজ করছে না। ফলে ভয়াবহ ওষুধ প্রতিরোধী টাইফয়েড জ্বরের প্রকোপ দিন দিন বাড়ছে। টাইফয়েড টিকা গ্রহণ করলে এই জ্বরে আক্রান্ত হবার হার বহুলাংশে হ্রাস পাবে। ফলে এন্টিবায়োটিক এর অপপ্রয়োগ কমে আসবে।
মহাপরিচালক আরো বলেন, সারাদেশে ১২ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া মাসব্যাপী টাইফয়েড টিকাদান ক্যাম্পেইন শিশুদের টাইফয়েড সংক্রমণজনিত অসুস্থতা ও মৃত্যুহার বহুলাংশে কমাবে।
তিনি বলেন, ক্যাম্পেইনের আওতায় প্রায় ৫ কোটি শিশুর প্রতিজনকে অত্যন্ত কার্যকর ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা বিনামূল্যে প্রদান করা হবে।
মহাপরিচালক বলেন, টিকাদান কার্যক্রম চলাকালে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত প্রাক-প্রাথমিক (প্লে, নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন) থেকে ৯ম শ্রেণি/ সমমান (মাদ্রাসা, ইংরেজি মিডিয়াম) পর্যন্ত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বহির্ভুত ০৯ মাস থেকে ১৫ বছরের কম বয়সী সকল শিশুকে কমিউনিটি পর্যায়ে ইপিআই টিকাদান কেন্দ্রে বিনামূল্যে ১ ডোজ টাইফয়েড টিকা প্রদান করা হবে।
তিনি বলেন, ইতিমধ্যে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কওমি মাদ্রাসা, স্কাউট ও গার্লস গাইড এর সাথে সমন্বয়পূর্বক টিকা কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়াও সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তর, এনজিও বিষয়ক ব্যুরো, এবং বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও এর সহযোগিতায় সুবিধাবঞ্চিত শিশু, বেদে পল্লী, চা বাগান, এতিমখানা, শিশু/ কিশোর/কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র, পথশিশু, যৌনপল্লীতে থাকা শিশুদের তালিকা করে বিশেষ ব্যবস্থাপনায় টাইফয়েড টিকা প্রদানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ইপিআই বাংলাদেশে স্বাস্থ্য সেবায় একটি অন্যতম সফল কার্যক্রম হিসেবে দেশ ও বিদেশে বহুল প্রশংসিত। ইপিআই টিকা কার্যক্রমের মাধ্যমে প্রতি বছর প্রায় ৪২ লক্ষ শিশুকে বিভিন্ন প্রাণঘাতী সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে টিকা দেওয়া হয় এবং এর মাধ্যমে প্রায় ১ লক্ষ শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
তিনি বলেন, ইপিআই এর ব্যবস্থাপনায় বিনামূল্যে যে টাইফয়েড টিকা দেয়া হচ্ছে সেটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দ্বারা পরীক্ষিত ও নিরাপদ। এটি একই সাথে প্রোটিন ও শর্করা থাকায় দুটি উপাদানই শরীরে টাইফয়েড রোগ প্রতিরোধী এন্টিবডি তৈরি করে।
তিনি বলেন, অন্যান্য টাইফয়েড টিকার তুলনায় এটি উন্নততর এবং অধিক কার্যকর। বাংলাদেশে এই টিকা কোন প্রকার ট্রায়াল বা পরীক্ষামূলক প্রয়োগ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার দেশের শিশুদের নিরাপদ ও কার্যকর টিকা প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ।
মহাপরিচালক বলেন, টাইফয়েড টিকা গ্রহণের পর অন্যান্য টিকার মতই সামান্য প্রতিক্রিয়া যেমন টিকাদানের স্থান লালচে হওয়া, সামান্য ব্যথা, ক্লান্তি ভাব হতে পারে যা এমনিতেই ভাল হয়ে যায়। এতে আতংকিত হবার কিছু নেই। তিনি টাইফয়েডের টিকা দিতে অভিভাবকদের সহায়তার আহ্বান জানান। সূত্র: বাসস
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত