ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজার বিরুদ্ধে ইউনাইটেড হাসপাতালের ১২ কোটি টাকার শেয়ার আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। ফরিদুর রহমান খান নামে হাসপাতালের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাদী হয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।
মামলার আসামিরা হলেন ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজা, মোস্তাক আহমেদ (পরিচালক, ইউনাইটেড হাসপাতাল), সাব্বির আহমেদ (পরিচালক, ইউনাইটেড হাসপাতাল) ও মোস্তাফিজুর রহমান (পরিচালক, ইউনাইটেড হাসপাতাল)।
মামলাটি তদন্ত করেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) উপ পুলিশ পরিদর্শক আবদুল মোত্তালেব হোসেন। সংশ্লিষ্ট মামলা সূত্রে এসব চাঞ্চল্যকর তথ্য জানা গেছে।
পুলিশ জানায়, আসামি হাসান মাহমুদ রাজা গত ৪ বছর ধরে আত্মসাৎকৃত এই শেয়ারের লভ্যাংশও হাতিয়ে নিচ্ছেন। পরিকল্পিতভাবে ওই শেয়ারের মালিক ও মামলার বাদী ফরিদুর রহমান খানকে হাসপাতাল থেকেও বের করে দিয়েছেন। ফরিদুর রহমান খান ইউনাইটেড হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন।
অভিযোগ আছে, রাজা শেয়ার আত্মসাৎ করে তা যৌথমূলধনী কোম্পানি ও ফার্মসমুহের পরিদপ্তরে (আরজেএসসি) জমা দেন।
এই ঘটনায় মামলার বাদী ফরিদুর রহমান খান বলেন, আসামিরা এখনো প্রতিনিয়ত তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন। প্রথমে মামলা না করার জন্য হুমকি দিয়েছেন। বলছে, মামলা করলে রাস্তায় লাশ ফেলে রাখবে। এখন মামলা তুলে নেওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এই ঘটনা ঘটে।
পিবিআই তদন্ত রিপোর্টে বলা হয়েছে, মামলার বাদী ও আসামি দু’জনের মধ্যে একসময় খুবই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে সূত্রে তাদের ব্যবসায়িক পথচলা। হাসান মাহমুদ রাজা, ফরিদুর রহমান খান, আবুল কালাম আজাদ, আহমেদ ইসমাইল হোসেন, খন্দকার মাইনুদ্দিন আহসান শামীম, আকতার মাহমুদ রানা এই ৬ বন্ধু মিলে তাদের ইউনাইটেড গ্রুপ এর পরিচালক ও শেয়ার হোল্ডার। ইউনাইটেড গ্রুমের মূল নাম হচ্ছে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ এন্ড কোম্পানি লিমিটেড। বাদীর অক্লান্ত পরিশ্রমে ইউনাইটেড গ্রুপ আজ হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদে পরিণত হয়েছে। এ কোম্পানির সিস্টার কর্নসার্ন ছিল ইউনাইটেড হসপিটাল। ফরিদুর রহমান খান কোম্পানি প্রতিষ্ঠার পর থেকে গত ১৫ বছর যাবত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তার হাত ধরে বিশ্বের দরবারে খ্যাতি অর্জন করেছে ইউনাইটেড হাসপাতাল। কিন্তু এক পর্যায়ে চেয়ারম্যান রাজা ফরিদুর রহমানের এই খ্যাতি মেনে নিতে পারেননি।
পুলিশের রিপোর্টে বলা হয়েছে ফরিদুর রহমান খান ইউনাইটেড হাসপাতালের ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৮৯টি শেয়ারের মালিক। ২০২০ সালের করোনা মহামারি চলাকালে ইউনাইটেড হাসপাতালের চেয়ারম্যান হাসান মাহমুদ রাজার নেতৃত্বে চারজন পরিচালক যোগসাজসে বাদীকে জোরপূর্বক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে পদত্যাগ করতে বাধ্য করান। এ সময় ফরিদ পদত্যাগ করতে অস্বীকার করলে রাজা তাকে হুমকি দিয়ে বলেন ‘জীবনের মায়া থাকলে তুই পদত্যাগ করবি, না থাকলে পদত্যাগ করবি না এটাই সিদ্ধান্ত’। এরপর প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে জোরপূর্বক তার কাছ থেকে স্বাক্ষর করিয়ে সে পদত্যাগ পত্র বোর্ড সভায় উত্থাপন না করেই ফরিদুর রহমানকে ছুটিতে পাঠিয়ে দেন। একই সঙ্গে আসামি রাজার নেতৃত্বে অন্যান্য আসামিরা জোরপূর্বক ফরিদুর রহমানের শেয়ারগুলো হস্তান্তর পত্রে স্বাক্ষর করে নেন।
২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসে আসামিরা দ্বিতীয় দফায় প্রতারণার মাধ্যমে প্রতিটি শেয়ারের দাম ১ হাজার টাকা নির্ধারণ করে ফরিদুর রহমানকে ১২ কোটি ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিবে বলে ফরম-১১৭ এ স্বাক্ষর করতে বলেন। বাদী ফরম ১১৭-এ স্বাক্ষর করতে গিয়ে দেখেন শেয়ার প্রতি দাম লেখা ১শ’ টাকা। বাদী ফরম-১১৭ এ স্বাক্ষর করলেও আসামিদের জানান পুরো টাকা বুঝে পাবার পরও তিনি কেবল আরজেএসসি‘র ফরমে স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু আসামিরা ফরিদুর রহমানকে কোনো টাকা না দিয়ে সব শেয়ার হস্তান্তরের জন্য আরজেএসসিতে কাজপত্র পাঠিয়ে দেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা বিষয়টি জানার জন্য আরজেএসসিতে চিঠি দেন। উত্তরে আরজেএসসি থেকে জানানো হয় ফরিদুর রহমানের শেয়ার হস্তান্তর প্রস্তাবটি এ পরিদপ্তরে এখনো রেকর্ডভুক্ত হয়নি।
তদন্তকাররী সংস্থা আরজেএসসিতে পাঠানো ২০২০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত শেয়ার হোল্ডারদের দলিল দস্তাবেজ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেন ফরিদুর রহমানের শেয়ার ২০২০ সালে ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৮৯টি হলেও ২০২৩ সালে দেখানো হয় ৩৯ হাজার ৬২৪টি। বাকী শেয়ারের মধ্যে আসামি হাসান মাহমুদ রাজা আত্মসাৎ করেন ১ লাখ ১৭ হাজার ৬৭৪টি। এছাড়া আহমেদ ইসমাইল হোসেনের নামে ১১৬২টি, আক্তার মাহমুদ রানার নামে ১১৬২টি, আবুল কালাম আজাদের নামে ১৬৭টি দেখানো হয়। সর্বমোট ১ লাখ ২০ হাজার ১৬৫টি শেয়ার আত্মসাৎ করেন আসামি রাজা। এছাড়া আসামিরা ফরিদুর রহমানের শেয়ারের বিপরীতে লভ্যাংশ হিসেবে পাওয়া শেয়ারও আত্মসাৎ করেন।
এ প্রসঙ্গে হাসপাতালের অন্যতম পরিচালক আবুল কালাম আজাদ পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ফরিদুর রহমান খানের কাছ থেকে তিনি কিভাবে ১৬৭টি শেয়ার পেয়েছেন কিছুই জানেন না। অপর পরিচালক ইসমাইল হোসেনও পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে কিভাবে তিনি ১১৬২টি শেয়ার পেয়েছেন তাও জানেন না। তারা জানিয়েছেন, শেয়ার হস্তান্তর করতে হলে বোর্ড সভার অনুমোদন নিতে হয়। তারা বলেছেন, এরকম কোনো বোর্ড সভা হয়নি, বা বোর্ড সভায় এ ধরনের কোনো এজেন্ডাও কখনো ছিল বলে তাদের মনে পড়ছে না।
এ বিষয়ে গত ১০ জুলাই ২০২৪ সালে বাদী ফরিদুর রহমান খান আরজেএসসিতে একটি অভিযোগ পত্র দাখিল করেন। সেখানে তিনি জানান, ইউনাইটেড হাসপাতালে তার মোট শেয়ারের পরিমাণ ১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৮৯টি। তিনি এখন পর্যন্ত কোনো শেয়ার হস্তান্তর করেননি। তবে আসামিরা জোরপূর্বক তার কাছ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার ১৬৫টি শেয়ার হস্তান্তর করেছেন বলে স্বাক্ষর নিয়েছেন। তিনি এই শেয়ারের বিপরীতেও কোনো টাকা পাননি।
এ বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা ইউনাইটেড হাসপাতালের কাছে লিখিত চিঠি দিলেও আসামি হাসান মাহমুদ রাজার কাছ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো চিঠির উত্তর পাননি বলে জানান। তদন্তকারী সংস্থা ইতোমধ্যে তদন্ত রিপোর্ট আদালতে হস্তান্তর করেছেন। তদন্ত রিপোর্টে আসামি হাসান মাহমুদ রাজার বিরুদ্ধে ফরিদুর রহমান খানের আনিত অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
হাসপাতালের অডিট রিপোর্ট ও প্রতারণার মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে বলে তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। এই অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অডিট ফার্ম হুদাবাসি জড়িত বলে তদন্ত রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ইউনাইটেড গ্রুপের হাসান মাহমুদ রাজার মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি। গ্রুপ সূত্রে জানা গেছে-বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে আছেন। গ্রুপের পিআর কোম্পানিকে বিষয়টি জানিয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য জানালেও তারা দেয়নি।
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত