ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, অর্থ পাচার, ঘুষ লেনদেন, অনলাইন জুয়া ও বেটিং, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে অর্থায়ন, ক্রিপ্টোকারেন্সি লেনদেনসহ নানা অবৈধ আর্থিক কার্যক্রমে বাংলাদেশ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। একই সঙ্গে লেনদেন বিবরণী আয়কর রিটার্নে সংযুক্ত করার বিধান না থাকার সুযোগ নিয়ে কিছু অসাধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঘুষ লেনদেনের মাধ্যম হিসেবেও জনপ্রিয়।
গতকাল বেলা ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে মাইডাস সেন্টারে টিআইবি কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে মোবাইল আর্থিক সেবা খাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, পরিচালক (রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি) মুহাম্মদ বদিউজ্জামানসহ আরও অনেকে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, অনলাইন জুয়ায় প্রায় ১ হাজার ১০০ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (এমএফএস) এজেন্ট শনাক্ত করা হয়েছে। আইপিএল-বিপিএলের মতো টুর্নামেন্টকে কেন্দ্র করে দেশে দেদার মোবাইলে অনলাইন জুয়ার অর্থ লেনদেন হলেও তা বন্ধে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয় না সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো। শুধু খুদেবার্তা পাঠিয়ে দায় সারছে সেবাদাতারা।
এদিকে টিআইবির গবেষণা বলছে, এমএফএস খাতকে করায়ত্ত করা এবং বিদ্যমান সুশাসনের ঘাটতির ফলে এই খাতে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র সংকুচিত এবং সুষ্ঠু বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। গ্রাহকের স্বার্থ উপেক্ষিত হয়েছে যেখানে উচ্চ হারে সেবামূল্য ধার্য করার মাধ্যমে গ্রাহকের ওপর আর্থিক বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি গ্রাহক ও রাষ্ট্রীয় অর্থ আত্মসাতের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া এই খাতের মাধ্যমে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাঙ্ক্ষিত আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। এমএফএস খাতে দীর্ঘ সময় ধরে পূর্ণাঙ্গ আনুষ্ঠানিক আইনি কাঠামোর অনুপস্থিতি এবং বিধিমালার সীমাবদ্ধতার ফলে একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংক-নেতৃত্বাধীন অধিকাংশ এমএফএসপি পৃথক পরিচালনা পর্ষদ ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে, সেখানে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ এমএফএস কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। এ ছাড়াও অনেক এমএফএসপিতে সুনির্দিষ্ট জনবলকাঠামো নেই। ব্যাংক-নেতৃত্বাধীন অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে পূর্ণকালীন কর্মীর সংখ্যা ২০ জনেরও কম। এমএফএসপি গ্রাহকের পূরণ করা ই-কেওয়াইসি ফরমের তথ্য এনআইডিডাব্লিউ থেকে নির্ধারিত ফি’র বিনিময়ে যাচাই করার সুযোগ থাকলেও কার্যকর সমন্বয়ের অভাবে অনেক সময় এই যাচাইকরণ প্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। এর ফলে অনৈতিকভাবে হস্তগত করা অন্যের এনআইডি ব্যবহার করে হিসাব খোলার সুযোগ থেকে যায়।
টিআইবি জানায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেনের চেয়ে এমএফএস ব্যবহার করে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে গ্রাহকদের বহু গুণ বেশি সেবামূল্য পরিশোধ করতে হয়। প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশে এমএফএস সেবামূল্য সর্বোচ্চ। সন্দেহজনক লেনদেন ও হুন্ডি কার্যক্রম শনাক্ত এবং প্রতিরোধে এমএফএসপিসমূহের সক্ষমতা এখনো আশানুরূপ নয়।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ২০২২ সালের নভেম্বর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত জালিয়াতি ও প্রতারণার শিকার হওয়া ব্যক্তিগত হিসাবধারীদের মধ্যে ৫২ দশমিক ৬ শতাংশ প্রলোভন/মিথ্যা তথ্য, ৪২ দশমিক ১ শতাংশ ফোনকল/এসএমএস পাঠিয়ে প্রতারণা এবং ১২ দশমিক ৩ শতাংশ অ্যাকাউন্ট হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে। যার মধ্যে ব্যক্তিগত হিসাবধারীরা সর্বনিম্ন ৩০০ থেকে সর্বোচ্চ ৮৩ হাজার টাকা পর্যন্ত, এজেন্টরা সর্বনিম্ন ২০০ থেকে সর্বোচ্চ ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা এবং মার্চেন্ট হিসাবধারীরা সর্বনিম্ন ৫৩ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জালিয়াতি ও প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
অন্যদিকে বিভিন্ন অনলাইন গ্যাম্বলিং ও গেমিং বা বেটিংয়ের অর্থ লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে এমএফএস। অনলাইন জুয়ার বিভিন্ন ওয়েবসাইট কিংবা অ্যাপে লেনদেনের জন্য বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় এর অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করা হলেও সংশ্লিষ্ট এমএফএসপি তা বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। ক্রিকেট খেলাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে অনলাইন বেটিং অধিক সক্রিয় হয় বিশেষ করে আইপিএল, বিপিএল ও বিশ্বকাপের সময়ে।
আর ২০২২ সালে এমএফএস ব্যবহার করে ৭৫ হাজার কোটি পাচার হয়েছে বলে সিআইডির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
টিআইবির গবেষণায় উঠে এসেছে, সরকারি ভাতা ও উপবৃত্তি বিতরণে আর্থিক জালিয়াতি এবং নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত ই-মানি তৈরির মাধ্যমে আত্মসাৎ করা প্রায় ২ হাজার ৩৫৬ কোটি টাকা নগদ লিমিটেডের বেনামী শেয়ারহোল্ডারদের মাধ্যমে বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বিকাশ বিদেশি বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে চুক্তির অর্থ (৪ লাখ ১০ হাজার ডলার) অনুদানের নামে পরিশোধ করে, যা ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন (সংশোধিত) অ্যাক্ট, ২০১৫’-এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।