অলৌকিক ঘটনায় প্রভাবিত হওয়া মানুষের স্বভাবজাত বিষয়। প্রাকৃতিক নিয়মের বাইরে সংঘটিত ঘটনাগুলো মানুষকে আকর্ষণ করে। মানুষের মাঝে আস্থা ও ভক্তি তৈরি করে। তাই ঈমান-আমল ত্রুটিমুক্ত রাখতে হলে অলৌকিক ঘটনার কারণগুলো বোঝা জরুরি।
কারণ সব অলৌকিক ঘটনা ঈমান মজবুত করে না। বরং কিছু অলৌকিক ঘটনার উৎস হয় শয়তানের কারসাজি ও ধোঁকা, যা মানুষকে বিভ্রান্ত করে। ঈমানকে ত্রুটিযুক্ত করে। পৃথিবীতে মানুষ যেসব অলৌকিক ঘটনা দেখে প্রভাবিত হয়, তা তিন ধরনের হতে পারে।
এক. মুজিজা; যা আল্লাহর সাহায্যে নবী-রাসুল ছাড়া অন্যদের মাধ্যমে সংঘটিত হওয়া সম্ভব নয়। দুই. কারামত; যা মহান আল্লাহর কিছু কিছু নেক বান্দার মাধ্যমে সংঘটিত হয়। তিন. শয়তানের কারসাজি; যা দুষ্ট জিন সাধনা বা প্রতারণামূলক কৌশল অবলম্বন করে যে কারো মাধ্যমে সংঘটিত হতে পারে। নিম্নে প্রতিটি উদাহরণসহ তুলে ধরা হলো :
মুজিজা : ‘মুজিজা’ শব্দটি আরবি ‘ইজাজ’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো ‘অক্ষম করা’।
মুজিজা অর্থ ‘অক্ষমকারী অলৌকিক নিদর্শন’, যাকে কোরআনের ভাষায় ‘আয়াত’ও বলা হয়। আল্লাহর সাহায্যে তাঁর মনোনীত নবী-রাসুলগণ তাঁদের নবুয়তের/রিসালাতের দাবি প্রমাণ করতে যেসব অলৌকিক নিদর্শন প্রদর্শন করেন সেগুলোকে ‘মুজিজা’ বলা হয়।
মুজিজা মূলত আল্লাহর পক্ষ থেকে আসত। অবিশ্বাসীরা যখন নবী-রাসুলদের তাঁদের নবুয়তের প্রমাণস্বরূপ কোনো অলৌকিক বিষয় উপস্থাপনের জন্য চ্যালেঞ্জ করত, তখন মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর নবী-রাসুলদের সাহায্য করার জন্য ‘মুজিজা’ হিসেবে আসমানি মদদ আসত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে—তারা বলল, ‘তোমরা তো আমাদের মতোই মানুষ, তোমরা আমাদেরকে আমাদের পিতৃপুরুষরা যার ইবাদত করত, তা থেকে ফিরাতে চাও।
অতএব তোমরা আমাদের কাছে স্পষ্ট প্রমাণ নিয়ে এসো’। তাদেরকে তাদের রাসুলগণ বলল, ‘আমরা তো তোমাদের মতোই মানুষ, কিন্তু আল্লাহ তাঁর বান্দাদের মধ্যে যাকে ইচ্ছা অনুগ্রহ করেন। আর আল্লাহর অনুমতি ছাড়া তোমাদের কাছে প্রমাণ নিয়ে আসার সাধ্য আমাদের নেই। আর শুধু আল্লাহর ওপরই মুমিনদের তাওয়াক্কুল করা উচিত’। (সুরা : ইবরাহিম, আয়াত : ১০-১১)
পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ তাঁর কোনো নবীকে কি মুজিজা দিয়ে সাহায্য করেছেন, তার উল্লেখ রয়েছে। যেমন নুহ (আ.)-এর নৌকার মুজিজা, ইবরাহিম (আ.)-এর অগ্নিকুণ্ডে নিরাপদ থাকার মুজিজা, মুসা (আ.)-এর লাঠি ও অন্যান্য মুজিজা, ঈসা (আ.)-এর মৃতকে জীবিত করা ও অন্যান্য মুজিজা, মুহাম্মদ (সা.)-এর চন্দ্র দ্বিখণ্ডিত করা, ইসরা, মিরাজ ও অন্যান্য মুজিজার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।
কারামত : যদি আল্লাহর বিশেষ সাহায্যে ঈমান ও তাকওয়ার অধিকারী ফরজ ও নফল ইবাদত পালনকারী কোনো ব্যক্তি থেকে কোনো অলৌকিক কর্ম প্রকাশিত হয়, তবে তাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘কারামাত’ বলা হয়। একেও পবিত্র কোরআনে ‘আয়াত’ বলা হয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তাদেরকে সে ব্যক্তির বৃত্তান্ত পড়ে শোনাও যাকে আমি ‘আয়াত’ বা অলৌকিক নিদর্শন দিয়েছিলাম। অতঃপর সে তা থেকে বিচ্যুত হয়, ফলে শয়তান তাকে তার অনুসারী বানিয়ে নেয় এবং সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৭৫)
এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাসসিরগণ পূর্ববর্তী যুগের বিভিন্ন ওলির কথা উল্লেখ করেছেন, যাদেরকে আল্লাহ ‘কারামাত’ দান করেন, কিন্তু আল্লাহর হুকুম অমান্য করায় তাঁরা বিপথগামী হয়ে যান। বোঝা গেল, ওলিদের দ্বারা সংঘটিত কারামতকেও পবিত্র কোরআনে ‘আয়াত’ বলা হয়েছে। তবে এই আয়াতে এ ব্যাপারে সতর্কবার্তা পাওয়া যায় যে একজন নেককার মানুষ বিলায়াত ও কারামাত লাভের পরও বিভ্রান্ত হতে পারেন। ‘কারামত’ প্রকাশিত হওয়া ওলি হওয়ার প্রমাণ নয়। বরং জীবনের শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ঈমান ও তাকওয়া, অর্থাৎ পাপ বর্জন ও অনবরত ফরজ ও নফল ইবাদত পালন করতে থাকাই বেলায়াতের একমাত্র চিহ্ন। তাই কারো থেকে কোনো কারামত প্রকাশ হওয়ার পর তাঁর মধ্যে ঈমান ও তাকওয়াবিরোধী কাজ পাওয়া গেলে বুঝতে হবে যে এটা তাঁর কারামত ছিল না, বরং এটা ছিল ইস্তিদরাজ। কোনো পাপী ও অবিশ্বাসী ব্যক্তি থেকে অলৌকিক কিছু প্রকাশিত হলে তাকে ইস্তিদরাজ বলে।
শয়তানি কারসাজি বা জাদু : শরিয়তের পরিভাষায় জাদু হলো এমন এক ধরনের কাজ, যা মানুষের চোখে প্রতারণা সৃষ্টি করে, জিনিসকে তার প্রকৃত রূপ থেকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করে। যেমন—সুরা ত্বহায় ফেরাউনের লেলিয়ে দেওয়া জাদুকরদের কথা উল্লেখ রয়েছে, যারা মুসা (আ.)-কে ভয় দেখাতে অলৌকিক ঘটনা ঘটিয়েছিল। কিন্তু মহান আল্লাহর সাহায্যে তার সব প্রতারণা মুহূর্তে ধুলায় মিশে যায়। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, “আমি বললাম, ‘তুমি ভয় পেয়ো না, নিশ্চয় তুমিই বিজয়ী হবে।’ তোমার ডান হাতে যা আছে তা নিক্ষেপ করো, তারা যা করেছে এটা তা সব গিলে ফেলবে, তারা যা করেছে তা তো কেবল জাদুকরের কলাকৌশল। জাদুকর যে রূপ ধরেই আসুক না কেন, সফল হবে না।” (সুরা : ত্বহা, আয়াত : ৬৮-৬৯)
আবার অনেকে বিভিন্ন প্রতারণামূলক কৌশল কিংবা কেমিক্যাল ব্যবহার করে ভেলকি দেখিয়েও মানুষকে বিভ্রান্ত করে, অথচ বাস্তবে তার পেছনে বিজ্ঞানের কোনো সূত্র বা নিছক হাতের খেলা হয়ে থাকে।
ইবনে তাইমিয়াহ (রহ.)-এর একটি ঘটনা প্রচলিত আছে। যেখানে তাঁর সঙ্গে রিফাঈয়াদের বিতর্ক হয়েছিল। তারা বলেছিল, ‘আমরা আগুনে ঢুকব। যদি কেউ পুড়ে যায়, তবে সে মিথ্যাবাদী, আর যে না পুড়বে সে সত্যবাদী।’
ইবনে তাইমিয়াহ বললেন, ‘আমি রাজি, তবে শর্ত হলো—সবাই আগে গোসল করবে।’ তিনি জানতেন তারা শরীরে এমন তেল মেখেছে, যা আগুনে পোড়ে না। শর্ত মানতে না চাওয়ায় প্রমাণ হলো তারা প্রতারণাকারী।
তাই ঈমান-আমলহীন কারো দ্বারা অলৌকিক কিছু ঘটলেই তাকে শতভাগ হক কিংবা আল্লাহর বিশেষ ওলি ভাবার সুযোগ নেই। দেখতে হবে সে তার ব্যক্তিগত জীবনে কোরআন-হাদিস মোতাবেক কতটুকু পালন করে। তার কর্মকাণ্ডে কুফর, শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে কি না! কেননা কিয়ামতের আগে দাজ্জালও অলৌকিক ঘটনা দেখিয়ে মানুষকে ঈমানহারা করবে।