রবিউল আউয়াল মাস। প্রত্যেক মুমিনের জন্য এটি আনন্দ ও ভালোবাসার মাস। কারণ এ মাসেই অন্ধকারাচ্ছন্ন গোটা পৃথিবী আলোকিত করে পৃথিবীতে আসেন বিশ্বনবী প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.)।
তাঁর আগমনের আগে গোটা পৃথিবী অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল।
জীবনের এমন কোনো দিন নেই, সেদিকে ছিল কিঞ্চিৎ আলোকচ্ছটা। সেই অন্ধকার পৃথিবী আলোকিত করতে মহান রাব্বুল আলামিন একজন মহামানবকে প্রেরণ করলেন। যাঁর পবিত্র পরশে আলোকিত হয়ে যায় গোটা পৃথিবী। তাঁর আগমন সম্পর্কে কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘অবশ্যই আল্লাহ মুমিনদের ওপর অনুগ্রহ করেছেন, যখন তিনি তাদের মধ্য থেকে তাদের প্রতি একজন রাসুল পাঠিয়েছেন, যে তাদের কাছে তাঁর আয়াত তিলাওয়াত করে এবং তাদের পরিশুদ্ধ করে আর তাদের কিতাব ও হিকমাত শিক্ষা দেয়।
যদিও তারা এর আগে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে ছিল।’ (সুরা : আলে ইমরান, আয়াত : ১৬৪)
তিনি ছিলেন এক আলোর প্রদীপ, যে প্রদীপের আলোয় চারদিক থেকে অন্ধকার দূর হয়ে যায়। ইবনে সাআদের বর্ণনায় এসেছে, মা আমেনা বলেছেন, যখন তাঁর পুত্র মুহাম্মদ (সা.) জন্মগ্রহণ করেন, তখন তাঁর দেহ থেকে এমন একটি নুর বের হলো, সেই নুরের দ্বারা শাম অঞ্চলের দুটি রাজকীয় প্রাসাদ উজ্জ্বল হয়ে গেল। সুবহানাল্লাহ!
শিশু অবস্থা থেকেই তিনি আলো ছড়াতে থাকেন, যে আলোর আভা পেয়েছিলেন মহীয়সী নারী তাঁর দুধ মাতা হালিমা সাদিয়া (রা.)।
আরবদের শহরের নাগরিকদের রীতি ছিল, তারা তাদের শিশুদের শহরের দূষিত পরিবেশ থেকে ভালো রাখার জন্য দুগ্ধ পান করাতে গ্রামের বেদুইন নারীদের কাছে পাঠাতেন।
যখন হালিমা বিনতে জুয়াইব তাঁর ঘরে নেওয়ার জন্য শিশু মুহাম্মদ (সা.)-কে বেছে নিলেন, তখন তিনি এমন আশ্চর্য ঘটনার সম্মুখীন হলেন—
সিরাতে ইবনে ইসহাকের বর্ণনা মতে, মা হালিমা বলেন, আমরা মক্কার শিশুদের আনতে সাদ গোত্রের নারীদের সঙ্গে বের হলাম। সেটা ছিল কঠিন দুর্ভিক্ষের বছর। চারদিকে চলছিল অভাব-অনটন। আমি মাদি দুর্বল একটি গাধার পিঠে সওয়ার ছিলাম, আমাদের কাছে একটি উটনিও ছিল, কিন্তু তা এক ফোঁটা দুধও দিত না।
আমাদের ছোট্ট শিশুরা ছটফট করত, রাতে ঘুমাতে পারতাম না। চারদিকে ভয়ংকর অভাব। বৃষ্টি ও একটু স্বাচ্ছন্দ্যের আশায় আমরা গভীর অপেক্ষায় থাকতাম। আমরা যখন মক্কায় পৌঁছলাম, আমাদের কাফেলার সব নারীকে রাসুলকে গ্রহণ করার জন্য পেশ করা হলো, কিন্তু এতিম হওয়ায় সবাই তাঁকে গ্রহণ করতে অস্বীকার করল। কেননা সবাই সন্তানের পরিবার থেকে ভালো পারিশ্রমিকের আশা করত। একজন বিধবা মা কী আর সেই আশা পূরণ করতে পারবে? তাই শিশু মুহাম্মদকে নিতে কেউ রাজি হয়নি। এদিকে আমি কাউকে না পেয়ে স্বামীর সঙ্গে পরামর্শ করে শিশু মুহাম্মদকে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করলাম, যেন খালি হাতে ফিরে না যেতে হয়।
হালিমা বলেন, এবার শুরু হলো আলোর জ্যোতি। এ শিশুকে গ্রহণ করার পর থেকে আমি আলোকিত হয়ে গেলাম। আমাদের দুগ্ধপোষ্য শিশুদের আর না খেয়ে থাকতে হলো না, এদিকে আমার স্বামী উটনী দোহন করতে গিয়ে লক্ষ করলেন, তার ওলানে দুধ পরিপূর্ণ, তিনি এত দুধ দোহন করলেন আমরা তৃপ্তি সহকারে পান করলাম, আরামে রাত পার করলাম।
সকালে স্বামী উঠে বলেন, খোদার কসম! হালিমা তুমি একজন বরকতময় শিশু গ্রহণ করেছ!
তারপর হালিমা বলেন, আমি দুর্বল গাধার পিঠে রওনা হলাম। শিশুটি আমার কোলে ছিল, গাধা এত দ্রুত পথ চলল যে সবার আগে বাড়িতে পৌঁছে গেল। যখন বাড়িতে এলাম, গ্রামে দুর্ভিক্ষ চলছিল, জমিতে মরা ঘাস ছিল, গাছপালার পাতা ঝরে পড়ছিল, বকরিগুলো না খেয়ে শুকনো ছিল। কিন্তু এ শিশুটিকে আনার পর থেকে জমিতে সবুজ ঘাসের সমারোহ হলো, ফলেফুলে আমাদের বাড়ির আঙিনা ভরে গেল, আমাদের বাড়ির বকরিগুলো চারণভূমিতে ভরা পেট নিয়ে বাড়িতে ফিরে আসত, অথচ তখন পাশের গ্রামে দুর্ভিক্ষ চলছিল। আসলে সবই ছিল শিশু মুহাম্মদের আলোকিত পরশের বরকত!
এভাবে মা হালিমার ঘর থেকে আলো বিতরণ শুরু করলেন তিনি। তারপর গোটা আরব থেকে শুরু করে সারা পৃথিবী আজ তাঁর আলোয় আলোকিত। (ইবনে হিশাম প্রথম খণ্ড : ১৬২-১৬৪)
লেখক : ইমাম ও খতিব, বায়তুল মামুর জামে মসজিদ, ঢাকা
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন