হজ ও ওমরাহর সফরে সবাই মক্কায় কাবাগৃহ, হাজরে আসওয়াদ ও সাফা-মারওয়া ছাড়াও আরো নির্ধারিত কিছু জায়গায় জিয়ারত করে থাকেন। যেগুলোর সঙ্গে ইসলামের ইতিহাস, নবীজি (সা.)-এর জীবনের বিশেষ সম্পর্ক আছে। এই স্থানগুলো মক্কা ও তার আশপাশের এলাকায় অবস্থিত এবং ইসলামের ইতিহাস ও হজের আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। নিচে প্রতিটি স্থানের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা ও তাৎপর্য দেওয়া হলো—
১. আরাফা ময়দান
অবস্থান : মক্কা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার পূর্বে।
তাৎপর্য : হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ‘উকুফে আরাফা’ এখানে পালিত হয়। ৯ জিলহজের দিনে হাজিরা এখানে দাঁড়িয়ে দোয়া ও ইস্তিগফার করেন। আব্দুর রহমান ইবনে ইয়ামুর (রা.) থেকে বর্ণিত যে নজদবাসী কিছু লোক রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে এলো, তখন তিনি আরাফায় ছিলেন। তারা হজ সম্পর্কে তাঁকে জিজ্ঞাসা করে।
তিনি তখন এক ঘোষণাকারীকে এই মর্মে ঘোষণা দিতে নির্দেশ দিলেন যে হজ হলো আরাফাতে অবস্থানের নাম।...
(জামে তিরমিজি, হাদিস : ৮৮৯)
বিশেষত্ব : এখানে রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন।
২. মুজদালিফা
অবস্থান : আরাফাত ও মিনার মাঝে।
তাৎপর্য : ৯ জিলহজ সূর্যাস্তের পর হাজিরা আরাফাত থেকে মুজদালিফায় আসেন এবং এখানে মাগরিব ও ইশার নামাজ একসঙ্গে পড়েন, রাত যাপন করেন এবং ১০ জিলহজ ফজরের পর মিনায় যান।
এখানে জামারায় নুড়ি সংগ্রহ করা হয়।
বিশেষত্ব : মুজদালিফায় রাত যাপন হজের একটি ওয়াজিব আমল।
৩. মসজিদে নামিরা
অবস্থান : আরাফাত ময়দানের কাছে।
তাৎপর্য : মসজিদে নামিরাহ সৌদি আরবের মক্কা প্রদেশের ওয়াদি উরানায়, আরাফাতের কাছে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। এটি হজের সময় গুরুত্বপূর্ণ স্থান, কারণ এখানে আরাফাতের দিনে (৯ জিলহজ) জোহর ও আসর নামাজ একসঙ্গে জামাতে আদায় করা হয় এবং খুতবা প্রদান করা হয়।
বিশেষত্ব : মসজিদটি আংশিকভাবে আরাফাতের বাইরে, তাই উকুফের জন্য আরাফাতের মধ্যে থাকতে হয়। মসজিদটি আব্বাসীয় খিলাফতের সময় (নবম শতাব্দী) নির্মিত হয়। সৌদি শাসনামলে এটির বৃহৎ সম্প্রসারণ হয়, যার ফলে এটি ১৮ হাজার বর্গমিটারে বিস্তৃত হয় এবং হাজার হাজার মুসল্লি ধারণ করতে পারে। সম্প্রসারণে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন রিয়াল ব্যয় হয়েছে।
৪. মিনা প্রান্তর
অবস্থান : মক্কা থেকে প্রায় আট কিলোমিটার পূর্বে।
তাৎপর্য : হজের সময় হাজিরা ১০, ১১, ১২ ও ১৩ জিলহজ এখানে অবস্থান করেন। এখানে জামারায় পাথর নিক্ষেপ, কোরবানি ও তাশরিকের দিনগুলো পালন করা হয়। মিনায় জামারাতে পাথর নিক্ষেপের পর হাজিরা কোরবানি দেন, যা ইবরাহিম (আ.) ও ইসমাঈল (আ.)-এর ত্যাগের স্মরণে। এটি হজের ফরজ আমলগুলোর একটি।
বিশেষত্ব : এটি তাঁবুর শহর নামে পরিচিত, কারণ হাজিরা এখানে তাঁবুতে থাকেন।
৫. জাবালে সাওর
অবস্থান : জাবালে সাওর মক্কা শহরের দক্ষিণ-পূর্বে, মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
হিজরতের ঘটনা : জাবালে সাওর পাহাড়ের গুহায় (গারে সাওর) রাসুলুল্লাহ (সা.) ও আবু বকর (রা.) মদিনায় হিজরতের সময় তিন দিন আশ্রয় নিয়েছিলেন। মক্কার কুরাইশরা তাঁদের খুঁজতে এসেছিল, কিন্তু আল্লাহর অলৌকিক সাহায্যে তাঁরা রক্ষা পান। কোরআনে এ ঘটনার উল্লেখ আছে, যদি তোমরা তাকে (রাসুলকে) সাহায্য না করো, তবে আল্লাহ তাকে সাহায্য করেছেন, যখন কাফিররা তাকে বের করে দিয়েছিল। তিনি ছিলেন দুজনের একজন, যখন তাঁরা গুহায় ছিলেন। তিনি তাঁর সঙ্গীকে বললেন, ‘দুঃখ কোরো না, আল্লাহ আমাদের সঙ্গে আছেন।’ (সুরা : তাওবা, আয়াত : ৪০)
আবু বকর (রা.) বলেন, আমরা যখন (সাওর) গুহায় আত্মগোপন করেছিলাম। তখন আমি নবী করিম (সা.)-কে বললাম, যদি কাফিররা তাদের পায়ের নিচের দিকে দৃষ্টিপাত করে, তবে আমাদের দেখে ফেলবে। তিনি বলেন, হে আবু বকর, ওই দুই ব্যক্তি সম্পর্কে তোমার কি ধারণা, স্বয়ং আল্লাহ যাঁদের তৃতীয় জন। (বুখারি, হাদিস : ৩৬৫৩)
সিরাতের কিতাব অনুযায়ী, গুহার মুখে মাকড়সা জাল বুনে এবং পায়রা ডিম পেড়ে রেখেছিল, যা কুরাইশদের ভ্রম সৃষ্টি করে তাদের ফিরে যেতে বাধ্য করেছিল।
জাবালে সাওর হজ বা ওমরাহর আনুষ্ঠানিক অংশ নয়, তবে এটি ইসলামের প্রাথমিক ইতিহাসের একটি পবিত্র স্মৃতিচিহ্ন। হাজিরা ও দর্শনার্থীরা এটি পরিদর্শন করে রাসুল (সা.) ও আবু বকর (রা.)-এর ত্যাগের কথা স্মরণ করেন। এটি আল্লাহর ওপর ভরসা ও তাঁর সাহায্যের প্রতীক।
৬. জাবালে রহমত
অবস্থান : আরাফাত ময়দানে।
তাৎপর্য : এই পাহাড়টিকে ‘রহমতের পাহাড়’ বলা হয়। হাজিরা এখানে দাঁড়িয়ে দোয়া করেন, কারণ এটি আরাফাতের কেন্দ্রীয় অংশ। ৯ জিলহজ, হজের দিন লাখ লাখ হাজি এই পাহাড় ও তার চারপাশে সমবেত হন এবং দোয়া ও ইবাদতে লিপ্ত থাকেন। এখানে হজরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)-এর মিলন হয়েছিল বলে কথিত আছে।
বিশেষত্ব : এটি হজের সময় দোয়ার জন্য বিশেষ স্থান।
৭. মসজিদে খায়েফ
অবস্থান : মিনা প্রান্তর।
তাৎপর্য : এটি মিনার একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। এখানে রাসুল (সা.) হজের সময় নামাজ পড়েছিলেন। হজের সময় হাজিরা এখানে নামাজ আদায় করেন।
বিশেষত্ব : এটি হজের আনুষ্ঠানিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
৮. জাবালে নুর
অবস্থান : জাবালে নুর মক্কা শহরের উত্তর-পূর্বে, মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। গারে হেরা গুহায় রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রথম ওহি লাভ করেন। ৬১০ খ্রিস্টাব্দে, ৪০ বছর বয়সে, তিনি এখানে ধ্যানরত অবস্থায় জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে কোরআনের প্রথম আয়াত (সুরা : আলাক, আয়াত : ১-৫) লাভ করেন : ‘পড়ো তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন।’
ইসলামের সূচনা : এই ঘটনা ইসলামের সূচনা এবং নবুয়তের শুরু হিসেবে চিহ্নিত। তাই জাবালে নুরকে ‘আলোর পাহাড়’ বলা হয়, কারণ এখান থেকে ইসলামের আলো বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
৯. মসজিদে জিন
অবস্থান : মসজিদে জিন মক্কা শহরের পূর্ব দিকে, হুজুন পাহাড়ের নিচে এবং হুজুন ব্রিজ থেকে প্রায় ৫০ মিটার দূরে অবস্থিত। এটি জান্নাতুল মুয়াল্লা কবরস্থানের কাছাকাছি। মসজিদটির আয়তন প্রায় ৬০০ বর্গমিটার।
তাৎপর্য : জিনদের ঈমান আনা—মসজিদে জিনের নামকরণ হয়েছে এই ঘটনার কারণে যে এখানে একদল জিন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত শুনে ইসলাম গ্রহণ করেছিল। কোরআনের সুরা জিন (৭২তম সুরা) এই ঘটনার উল্লেখ করে। আয়াতে বলা হয়েছে, ‘অতঃপর তারা বলল, আমরা এক বিস্ময়কর কোরআন শুনেছি, যা সঠিক পথ প্রদর্শন করে। তাই আমরা তার ওপর ঈমান এনেছি...।’ (সুরা : জিন, আয়াত : ১-২)
এই ঘটনা মক্কার নাখলা এলাকায় সংঘটিত হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে এই স্থানে মসজিদ নির্মিত হয়। রাসুল (সা.) জিনদের কোরআন পড়ে শোনান এবং তাদের ধর্মীয় বিষয়ে শিক্ষা দেন। ১৩৯৯ হিজরিতে (১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দ) এই স্থানে নতুনভাবে মসজিদ নির্মিত হয়, যা মসজিদে জিন নামে প্রসিদ্ধ।
১০. জান্নাতুল মুয়াল্লা
অবস্থান : মক্কায়, মসজিদুল হারামের কাছে।
তাৎপর্য : এটি মক্কার প্রাচীনতম কবরস্থান। এখানে রাসুল (সা.)-এর স্ত্রী খাদিজা (রা.), সাহাবি আবদুর রহমান ইবন আউফ (রা.)-সহ অনেক সাহাবি ও তাবেঈনকে দাফন করা হয়েছে।
বিশেষত্ব : এটি ইসলামের প্রাথমিক যুগের ঐতিহাসিক কবরস্থান।
১১. মসজিদে আয়েশা (তানিম)
অবস্থান : মক্কার তানিম এলাকায়, মসজিদুল হারাম থেকে প্রায় সাত কিলোমিটার দূরে।
তাৎপর্য : এটি মিকাত স্থানগুলোর একটি। আয়েশা (রা.) এখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধেছিলেন। মক্কার বাসিন্দারা ওমরাহর জন্য এখান থেকে ইহরাম বাঁধেন।
বিশেষত্ব : ওমরাহর জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান।
১২. আবু কুবাইস পাহাড়
অবস্থান : মসজিদুল হারামের কাছে, মক্কায়।
তাৎপর্য : এটি মক্কার প্রাচীনতম পাহাড়। এখান থেকে ইবরাহিম (আ.) মানুষকে হজের ডাক দিয়েছিলেন বলে কথিত আছে। এটি ইসলাম-পূর্ব যুগেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
বিশেষত্ব : এটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় তাৎপর্য বহন করে।
বিডি প্রতিদিন/ ওয়াসিফ