আসছে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে টাস্কফোর্সের প্রধান সুপারিশগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এর জন্য সরকারি ব্যয় ও সম্পদ আহরণে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, আওয়ামী লীগের শাসনামলে অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর দেশের অর্থনীতি সঠিক পথে ফেরাতে অন্তর্বর্তী সরকার এ টাস্কফোর্স গঠন করে। টাস্কফোর্স ৩০ জানুয়ারি ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই উন্নয়নের জন্য অর্থনীতিকে পুনর্গঠন ও সম্পদ আহরণ’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বাজেটের জন্য নানান সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ আগের সরকারের আমলে দুর্নীতি, অদক্ষতা ও অপচয়ের কারণে বাজেট ব্যবস্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বাজেট প্রণয়নে মৌলিক নীতিমালা ও টাস্কফোর্সের সুপারিশ অনুসরণ করতে ইতোমধ্যে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য নীতির মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য হ্রাস, মানবসম্পদ উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা, সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং জিডিপি বৃদ্ধি ও মোট বাজেট বরাদ্দের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। এ বিষয়ে টাস্কফোর্সের সদস্য সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দীর্ঘদিনের রাজস্ব ঘাটতির কারণে সৃষ্ট সম্পদের স্বল্পতার প্রেক্ষাপটে অর্থ বিভাগের এ পদক্ষেপগুলো ইতিবাচক। অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটের আকার কমিয়ে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করতে পারে, যাতে বাজেট ঘাটতি পূরণে অতিরিক্ত ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা কমানো যায়।’ আওয়ামী লীগ সরকার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার সংশোধন করে ৭ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকায় নামিয়ে আনে এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা থেকে কমিয়ে ২ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকায় নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদের নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সের অন্যতম প্রধান সুপারিশ ছিল আর্থিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আর্থিক নীতি মুদ্রানীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। সরকার যদি বড় ধরনের বাজেট ঘাটতি রাখে ও অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ করে, তখন অতিরিক্ত অর্থ সরবরাহ বৃদ্ধির আশঙ্কায় মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন টাস্কফোর্সের সুপারিশকে সঠিক বলেছেন। তিনি বলেন, ‘কারণ আগের সরকারের সম্প্রসারণমূলক রাজস্ব নীতির কারণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি কার্যকর হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি স্থায়ী হয়ে গেছে।’ এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশ, ২০২৩-২৪-এ ৯ দশমিক ৭ শতাংশ এবং ২০২৪-২৫-এ বেড়ে ১০ দশমিক ২ শতাংশ পর্যন্ত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে জনগণকে রক্ষায় টাস্কফোর্স দারিদ্র্য হ্রাসভিত্তিক কর্মসূচিগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়ার সুপারিশ করেছে। যেমন বৃদ্ধভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি এবং দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যনিরাপত্তা কার্যক্রম।
টাস্কফোর্সের মতে বর্তমানে সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ অনেকটাই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। কারণ এর মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের পেনশন, সঞ্চয়পত্রের সুদ, ভূমিকম্প ও দুর্যোগ মোকাবিলায় যন্ত্রপাতি সংগ্রহ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি পরিচালনার আহ্বান জানিয়েছে টাস্কফোর্স।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১৭ শতাংশ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক খাতগুলো বাদ দিলে প্রকৃত বরাদ্দ দাঁড়ায় জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং বাজেটের ৭ শতাংশ।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) বিশ্ব সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিবেদন ২০২৪-২৬ অনুযায়ী, বাংলাদেশ সামাজিক সুরক্ষায় জিডিপির মাত্র ০.৯ শতাংশ ব্যয় করে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় গড় ৩.৮ শতাংশের তুলনায় অনেক কম। নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় ৪.২ শতাংশ এবং উচ্চমধ্যম আয়ের দেশগুলোর গড় ৮.৫ শতাংশ।
টাস্কফোর্স বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) ওপরও জোর দিয়ে বলেছে, সরকারের নীতিগত অগ্রাধিকার হওয়া উচিত এডিপির আকার ‘ব্যবস্থাপনাযোগ্য’ রাখা এবং বাস্তবায়ন সক্ষমতা, সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় এবং বিদেশি সাহায্যের ব্যবস্থাপনা সমস্যা সমাধান করা।
এ ছাড়া টাস্কফোর্স জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নীতিনির্ধারণী ও পরিচালন কাঠামো আলাদা করার, কর ও শুল্ক আদায় ব্যবস্থার স্বয়ংক্রিয়করণ, অঞ্চলব্যবস্থা বাতিল এবং এনবিআরের সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। বাংলাদেশের কর রাজস্বের হার ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির তুলনায় নেমে এসেছে ৮.৬ শতাংশে, যা দক্ষিণ এশিয়ার সর্বনিম্ন। ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। ২০২৬ সালে বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর অর্থায়নের জন্য দেশি বন্ড চালুরও পরামর্শ দিয়েছে টাস্কফোর্স।