জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (এনসিসি) সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, যেকোনো ক্রান্তিকালের দুটো দিক থাকে। একটা সম্ভাবনার আরেকটা চ্যালেঞ্জের। কারণ রাজনীতি সব সময় অনিশ্চয়তার বিষয়। বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কীভাবে অগ্রসর হবে, সেটার পথরেখা হচ্ছে জুলাই সনদ। আমি মনে করি, এই আকাক্সক্ষার চাপ সবার ওপরে আছে। দেশের নাগরিকরা আশায় আছেন। আশঙ্কার মধ্যেও আছেন, এটা হবে কি হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোরও একই অবস্থা। তিনি বলেন, সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর কোনো কারণ এখন পর্যন্ত দেখতে পাই না। তবে কমিশন কখনো কারও ওপর চাপ প্রয়োগ করবে না। নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের কোনো বিরোধ নেই। নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা ভিন্ন। ফলে সংস্কার এবং নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর প্রয়োজন নেই।
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এনসিসির মতো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে দায়িত্ব পালন করছেন। কেমন লাগছে?
আলী রীয়াজ : দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা পাচ্ছি। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকে এবং কমিশনের সদস্যদের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি। নিঃসন্দেহে এটা একটা বড় দায়িত্ব। সেই অর্থে সফলভাবে সম্পন্ন করার চাপ তো অনুভব করিই। সবার সহযোগিতা দেখে মনে হয়, এরকম একটা মুহূর্তে সবাই চাইছেন যেন আমরা সফল হই। ঐকমত্য কমিশন যেন সফল হয়। এটাই ব্যক্তিগতভাবে আমাকে অনুপ্রাণিত করে। এরকম একটা ঐতিহাসিক মুহূর্তে দায়িত্ব পাওয়ার সুযোগ পাওয়া গেছে এবং সেটা সবার সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এগোতে পারছি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অরাজনৈতিক ব্যক্তি হয়ে রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কাজ করছেন। অভিজ্ঞতা কী?
আলী রীয়াজ : কেউই অরাজনৈতিক নয়। ছাত্রজীবনে দীর্ঘদিন প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। ছাত্রজীবনের পরেও ছিলাম। ১৯৮৮ সালের পরে প্রত্যক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দল করিনি। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছি। সেই হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। গত ২২ বছর রাষ্ট্রবিজ্ঞান পড়াই। আমার কাজের ক্ষেত্র হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া, বিশেষ করে বাংলাদেশ। ফলে নিজেকে অরাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে বিবেচনা করি না। শুধু আমি নই আমরা কেউই অরাজনৈতিক নই। আমাদের জীবনাচরণ, আমরা যা বলি, যা করি সেটাও তো শেষ বিচারে রাজনীতি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রাজনৈতিক সংকটের কারণে দেশ অনেকটা ক্রান্তিলগ্নে। ভবিষ্যতে সংকট উত্তরণে আপনি কতটা আশাবাদী।
আলী রীয়াজ : বাংলাদেশ একটা সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যৎ পথরেখা তৈরির যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেই সুযোগ অনেক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। গত ৫৩ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে বহুবিধ বাধা লক্ষ করেছি। ১৬ বছর ধরে একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ। সেটাকে পরাজিত করতে পারা গেছে। এখন এই সম্ভাবনার জায়গাটাকেই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি। যেকোনো ক্রান্তিকালের দুটো দিক থাকে। একটা সম্ভাবনার আরেকটা চ্যালেঞ্জের। তাই চ্যালেঞ্জ তো আছেই। কারণ রাজনীতি সব সময় অনিশ্চয়তার বিষয়। আমি আশাবাদী, বাংলাদেশের মানুষের এই পরিস্থিতি এই ক্রান্তিকালের সম্ভাবনাকে বাস্তবায়নে আগ্রহ আছে। আশা করি, সেই আগ্রহকে বাস্তবায়ন করতে পারব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রাজনৈতিক স্থিতিশীলতায় কোন রাষ্ট্রীয় সংস্কারগুলো গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন?
আলী রীয়াজ : আমার বিবেচনায় কিছু সংস্কার অবিলম্বে করা দরকার। সেগুলো সরকার করছে। আমি আমার দায়িত্বের জায়গা থেকে বলতে পারি, আমাদের এই সুযোগটা হচ্ছে ভবিষ্যৎ পথরেখা তৈরি করার। গত ৫৩ বছরে এটা হয়নি। আমাদের এই সম্ভাবনার জায়গাটাকে বাস্তবায়নের এবং দীর্ঘমেয়াদি ভবিষ্যৎ বিবেচনা করা। সেদিক থেকে মনে করি সংবিধান, নির্বাচনি ব্যবস্থাপনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পাশাপাশি বিচার বিভাগের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো হচ্ছে একটি রিপাবলিকের ভিত্তি। জনপ্রশাসনও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের বিবেচনায় আমাদের কাজের জায়গা থেকে এটা দীর্ঘ মেয়াদে দেখতে হবে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সংস্কার নিয়ে দলগুলোর প্রস্তাবনা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
আলী রীয়াজ : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে, রাজনীতিবিদদের মধ্যে অনেক বিষয়ে ঐকমত্য আছে। তাই বলে মতপার্থক্য কী থাকবে না? অবশ্যই থাকবে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নিজস্ব উদ্দেশ্য রয়েছে। তারপরও মোটাদাগে অনেক জায়গায় ঐকমত্য আছে। একটা বড় ঐকমত্য যেটা দেখতে পাই, তাহলো সবাই বুঝতে পারছে রাষ্ট্র সংস্কারের মধ্য দিয়ে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের যাত্রাটাকে মসৃণ করতে হবে। এখন কীভাবে করা যায়, সেটা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। সেজন্যই ঐকমত্য তৈরি করার চেষ্টা। প্রত্যেকে আলাদাভাবে বলছেন কিন্তু লক্ষ্যের ব্যাপারে কোনো মতপার্থক্য দেখি না। পথ ভিন্ন। এখন আমাদের একটা পথ খুঁজে বের করতে হবে। যাতে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। এখানে কোনো দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ঐকমত্যকে সবচেয়ে কঠিন কাজ হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। সেই কাজটিই আপনার নেতৃত্বে করা হচ্ছে। সফলতার বিষয়ে কতটা আশাবাদী?
আলী রীয়াজ : প্রথম কথা হচ্ছে এই কমিশনের প্রধান হচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আমাকে সহসভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ফলে আমি বলব যে আমার নেতৃত্বের চেয়ে আমাদের সবার নেতৃত্বে কাজ হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, নেতৃত্বের অংশে নয় অংশীদারত্বের অংশ। এই কাজের অংশীদারত্ব সবার। যে কাজে অংশীদারত্ব সবার, সেখানে সফলতার সম্ভাবনা বেশি। আমি সেভাবেই বিবেচনা করি। আমরা এই জায়গায় বড় মাপের মূল্য দিয়েই তো এলাম। এর অংশীদারত্ব সবার। ফলে তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পারা, একসঙ্গে অগ্রসর হওয়াটাই হচ্ছে বিষয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : আপনি বলেছেন, সংস্কারে মৌলিক ইস্যুগুলোর বিরোধ সমাধান হবে আলোচনার টেবিলে। এটা কতটা ফলপ্রসূ হতে পারে বলে আপনার ধারণা?
আলী রীয়াজ : রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় এখন পর্যন্ত আমরা দেখেছি, তাদের মধ্যে নমনীয়তা অনেক। অনেক বিষয়ে তারা প্রাথমিকভাবে ভিন্নমত নিয়ে এলেও আলাপ-আলোচনার পরে পুনর্বিবেচনার কথা বলছেন। আমি মনে করি, অন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও সেটা হবে। কারণ এখানে কোনো দুই পক্ষ নেই। এখানে কেউ কারও কাছ থেকে কিছু আদায় করার চেষ্টা করছে না। লক্ষ্যের ব্যাপারে ভিন্ন মত নেই। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর দিক থেকে তো নিঃসন্দেহে এই আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন দেখতে চান। কমিশনের পক্ষ থেকে যে প্রস্তাবগুলো বা সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আলোচনার সূত্রপাত করছে। রাজনৈতিক দলগুলো তারা তাদের সেসব বিষয় নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। এখন কোথাও একমত হচ্ছে কোথাও আলাপ আলোচনা করছি। আমি এখনো মনে করি, অনেক কিছুই আমরা আলোচনা টেবিলে অর্জন করতে পারব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দলগুলোর প্রস্তাবনার মধ্যে ব্যতিক্রমী কী কী পেয়েছেন?
আলী রীয়াজ : ব্যতিক্রম এই অর্থে যে ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের কিছু কিছু ধারণা দেখতে পেয়েছি। যেমন কারও কারও বিবেচনায় এ মুহূর্তেই অনেক কিছু করণীয় আছে। কারও কারও বিবেচনায় যেহেতু রাষ্ট্র সংস্কারের বিষয়টি দীর্ঘমেয়াদি চলমান একটা প্রক্রিয়া। তারা সেদিকেই বেশি দৃষ্টি দিচ্ছেন। কিন্তু যেকোনো সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করতে হয়। এই শুরু করার জায়গাটাতেই আমি ওই ব্যতিক্রমটা দেখতে পেয়েছি। কেউ কেউ বলছেন এ মুহূর্তে আমরা শনাক্ত করি তারপর সংস্কার শুরু করা যাবে। আবার কেউ বলছেন, না; এখনই শুরু করা দরকার। তবে এককথায় আমরা শুরু করেছি। এই যে আলোচনা, এই যে সুপারিশ, রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া, এগুলো সূচনা।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে, এমন ধরনের চাপকে কীভাবে নিচ্ছেন?
আলী রীয়াজ : বাংলাদেশ ভবিষ্যতে কীভাবে অগ্রসর হবে, সেটার পথরেখা হচ্ছে জুলাই সনদ। সে ক্ষেত্রে চাপ শুধু আমি যে ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্বে আছি বলে সেজন্য না। বরং আমি মনে করি এই যে আকাক্সক্ষার চাপটা সবার ওপরে আছে। নাগরিকদের সঙ্গে কথা বলে দেখুন তারাও কিন্তু আশায় আছে। আশঙ্কার মধ্যেও আছে, এটা হবে কি হবে না। রাজনৈতিক দলগুলোরও একই অবস্থা। এই প্রক্রিয়ার মধ্যে থেকে আমি সংবিধান সংস্কার কমিটিতে থাকার সময় এবং এই কমিশনে দায়িত্ব থাকার সময় দেখেছি রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত আন্তরিক এবং সিরিয়াসলি নিয়েছে বিষয়টা। তারা নিজেরা আলাপ-আলোচনা করছে, কমিটির মধ্যে আলাপ আলোচনা করছে। প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : দলগুলোর মধ্য থেকে অভিযোগ এসেছে, সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানো হতে পারে। আপনার ব্যাখ্যা কী?
আলী রীয়াজ : সংস্কারের নামে নির্বাচন পেছানোর কোনো কারণ এখন পর্যন্ত আমি দেখতে পাই না। ঐকমত্য কমিশনের কাজ ফেব্রুয়ারি ১৫ তারিখে শুরু হয়েছে। লক্ষ করে দেখবেন, দুই মাস সময়ের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ছয়টি কমিশনের প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। তারা হার্ড কপি চেয়েছে, সেটাও দিয়েছি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়েছে। কারও কারও সঙ্গে আমরা অনানুষ্ঠানিক আলোচনাও করেছি। আনুষ্ঠানিক আলোচনা যত দ্রুত সম্ভব শুরু করা হয়েছে। ফলে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দীর্ঘসূত্রতার কোনো লক্ষণ আমাদের পক্ষ থেকে দেখতে পায় না। আর নির্বাচন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে যেটা লক্ষ করার বিষয় সেটা হলো, প্রধান উপদেষ্টা বারবার বলেছেন, এমনকি কমিশনের কাজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই তিনি বলেছেন, একটা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই তিনি নির্বাচনটা দেখতে চান। সেই লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনও কাজ করেছে কিছুটা। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতিও দেখতে পাই। ফলে এ কারণে নির্বাচন পিছিয়ে যাবে বা এ কারণে নির্বাচনের দীর্ঘসূত্রতা দেখা দেবে এরকম কিছু আমার কাছে মনে হয় না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : ঐকমত্য না হলে এর দায় কার ওপর বর্তাবে? আপনারা দায় নেবেন নাকি দলগুলোর ওপর বর্তাবে?
আলী রীয়াজ : আমি তো ইতিবাচক থাকতে চাই। ঐকমত্য অনেক বিষয়ে হবেই, এটা আমার আশা। সব বিষয়ে কি হবে? না সব বিষয়ে হবে না। তাহলে আমরা সাফল্য কোনটাকে বিবেচনা করব। সাফল্যকে আমরা বিবেচনা করতে পারব যতটুকু আমরা অর্জন করতে পারলাম। ফলে দায়ের প্রশ্নটা এখন আমরা না তুলি।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : অনেকে বলছেন, আপনারা সংস্কারে ঐক্য না করে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পেছানোর ব্যাপারে ঐক্য করার চেষ্টা করবেন, এ ব্যপারে আপনার বক্তব্য কী?
আলী রীয়াজ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দায়িত্ব নির্বাচনসংশ্লিষ্ট নয়। আমাদের যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা হলো রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের জায়গাটা তৈরি করা। কোথায় একমত আছে। এখন তো দেখি অনেক জায়গায় আছে, অনেক জায়গায় নাই। পাশাপাশি নাগরিকদের মতামত নিতে হবে। যে কারণে পরিকল্পনা করেছি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নাগরিকদের মতামত নেব। এরপর সম্ভব হলে তার জরিপ করা। সংবিধান সংস্কারের সময় আমরা জরিপ করেছিলাম। কিন্তু এগুলো করতে হবে দ্রুত। সময় তো বেশি নাই। এগুলোকে কেন্দ্র করে আমরা আমাদের কাজ প্রলম্বিত করতে পারি না, করবও না। আমার ব্যক্তিগতভাবে লক্ষ্য হচ্ছে ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে একটি সনদ তৈরি করা। আশা করছি, একটি জাতীয় সনদ হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর একটা বড় অংশ তার সঙ্গে একমত হবে। নাগরিকদের ইনপুটও তার মধ্যে থাকবে। এর মধ্য দিয়ে আমরা এক জায়গায় দাঁড়াতে পারব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : নির্বাচনের ব্যাপারে আপনারা কোনো প্রভাব খাটাবেন কি না, অর্থাৎ নির্বাচন আগে না সংস্কার আগে, এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগ করবেন কি না?
আলী রীয়াজ : জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনো কারও ওপর চাপ প্রয়োগ করবে না। এই কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা এবং যতটুকু সম্ভব সাফল্য অর্জন করা। নির্বাচনের সঙ্গে সংস্কারের আসলে কোনো বিরোধ নেই। নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা ভিন্ন। আমরা যেটা আশা করি সেটা হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি জাতীয় সনদ তৈরি করতে পারি তাহলে ভবিষ্যৎ পথরেখা নির্দেশ করবে। আর ভবিষ্যতের প্রথম পদক্ষেপটা হচ্ছে নির্বাচন। সেই নির্বাচনটাও একটা প্রতিফলন ঘটবে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে থেকে ঘটবে, নাগরিকদের মধ্য থেকে ঘটবে। রাজনৈতিক দলগুলো অবশ্যই নাগরিকদের প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু তার বাইরেও তো অনেকে আছেন। আমরা সবাই তো রাজনৈতিক দল করি না। তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তারই অংশ হিসেবে আমরা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মতামত নেওয়ার চেষ্টা করব। জরিপের মাধ্যমে তাদেরও অন্তর্ভুক্ত করব। ফলে সংস্কার এবং নির্বাচনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নাই।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : রাজনৈতিক দলগুলো পরিস্থিতির কারণে আপনাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে কিন্তু অনেক রাজনৈতিক দল ভিতরে ভিতরে আপনাদের সন্দেহ করছে, এটা কি আপনারা বুঝতে পারেন?
আলী রীয়াজ : রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন বিবেচনা থেকে মন্তব্য করে। তাদের তো বিভিন্ন ধরনের বিষয় রয়েছে। দল, দলের কর্মী, নাগরিক, সম্ভাব্য ভোটার। কিন্তু তারা তো সহযোগিতা করছেন। তারা মতামত দিচ্ছেন। আমাদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ রাখছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে অনেকে এসেছেন। আপনি যেটাকে সন্দেহ বলছেন, তাদের মধ্যে কিছু মতামত আছে। অ্যাপ্রেহিনশন আছে। থাকতেই তো পারে। যেকোনো কিছুটা অনিশ্চিত প্রক্রিয়ায় আমরা কিছুটা শঙ্কিত থাকব না? রাজনীতি তো অনিশ্চিত জিনিস, তাই কিছুটা শঙ্কা আছে। কিন্তু আমি ওই শঙ্কাাটাকে আমাদের কাজের জন্য বড় রকমের বাধা মনে করি না। আমি অনুরোধ করি, শঙ্কার জায়গাগুলোর পাশাপাশি সম্ভাবনার জায়গাগুলো তুলে ধরুন। সেগুলো বলুন। সেদিন আমি সাংবাদিকদের কিছুটা হালকা মেজাজে বলেছিলাম যে আপনারা আমাদের কাজের নজরদারি করুন। কারণ এটা জরুরি। আমাদের ত্রুটি হলে বলুন। তাহলে আমরা সংশোধন করার চেষ্টা করব। আবার যদি আমাদের কিছু প্রশংসার প্রাপ্তি হয় তাহলে কুণ্ঠিত হয় না। আমরা যদি একটু ভালো কাজ করি, রাজনীতিবিদরা যদি ভালো কাজ করে, তাহলে প্রশংসা করুন। এতে ভালো কাজ করার, সঠিক কাজ করার উদ্দীপনা তৈরি হয়।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এনসিসির মতামত নেওয়ার প্রক্রিয়া এমসিকিউ পদ্ধতির। এ নিয়ে কয়েকটি রাজনৈতিক দল গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। আপনার উত্তর কী?
আলী রীয়াজ : এটা এমসিকিউ পদ্ধতি নয়। এখানে ওনারা একটু ভুল বুঝছেন। যে স্প্রেডশিটটা তাদের কাছে পাঠানো হয়েছে, সেখানে সুপারিশগুলোর মধ্যে আমরা বলেছি- একমত, একমত নয়, আংশিক একমত ও মন্তব্য। এখানে মন্তব্য করতে পারছেন তারা। একইভাবে বাস্তবায়নের পথ উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানেও তারা মন্তব্য করতে পারছেন। আমরা যে চিঠি পাঠিয়েছি, সেখানে আমরা উল্লেখ করেছি এর বাইরেও কিন্তু আপনার মতামত দিতে পারেন। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন এ পর্যন্ত রাজনীতিবিদরা বলেছেন যে আমরা ১০০টার সঙ্গে ৯০টার সঙ্গে বা এতটার সঙ্গে একমত হয়েছি। দ্বিমত পোষণ করছি বা আংশিক একমত হয়েছে। এর ফলে কাজটা অনেক সহজ হয়েছে। মতামতের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের দীর্ঘ মতামত দেওয়ারও সুযোগ রয়েছে। সেটা তারা ব্যবহারও করছেন।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলায় আপনার লেখা তিনটি বইয়ের শিরোনাম হচ্ছে- ভয়ের সংস্কৃতি, বাংলাদেশের শাসক শ্রেণিসংকট ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ঐক্য। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এসব বইয়ের শিরোনাম এখনো কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন?
আলী রীয়াজ : কোনো বই যখন লেখা হয় তখন সাময়িক প্রেক্ষাপটের কথা চিন্তা করে লেখা হয়। যে তিনটা বইয়ের কথা বলছেন, সেগুলোর প্রত্যেকটাই এখনো প্রাসঙ্গিক।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : একসময় সাংবাদিকতা করেছেন। সেই আলোকে বাংলাদেশের বর্তমান সাংবাদিকতাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
আলী রীয়াজ : বাংলাদেশের সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে দাঁড়ায়নি। এটা দাঁড়াবার যে প্রক্রিয়া ছিল, যে সম্ভাবনা ছিল, যে পথগুলো ছিল, সেগুলো সত্তর থেকে আশির দশকের। কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পরে বিশেষ করে গত ১৬ বছরে সাংবাদিকতা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভয়াবহ রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে অগ্রসর হওয়ার জন্য আরও কিছুটা সময় লাগবে। যদি বাংলাদেশে আমরা গণতান্ত্রিক চর্চাটা করতে পারি। একটি অগণতান্ত্রিক সমাজে স্বাধীন, শক্তিশালী সাংবাদিকতা হয় না।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশকে আপনি কোথায় দেখতে চান?
আলী রীয়াজ : একটি গণতান্ত্রিক সমৃদ্ধিশালী জনগণের অংশগ্রহণমূলক একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থাকবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যেটা সেটা হচ্ছে, নাগরিকের অধিকার সংরক্ষিত থাকবে। ক্ষমতায় যারা থাকবেন, তারা একধরনের জবাবদিহির মধ্যে থাকবেন। রাষ্ট্র যেন, রাষ্ট্রের স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠান যেন নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : এনসিসির দায়িত্ব শেষ হলে কী করার পরিকল্পনা করেছেন?
আলী রীয়াজ : আমি শিক্ষকতা করি। এটা আমার পছন্দের পেশা বলেন, নেশা বলেন, প্যাশন বলেন, তাই। আমি শিক্ষকতার দায়িত্বটাই পালন করব।
বাংলাদেশ প্রতিদিন : বাংলাদেশ প্রতিদিনকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ
আলী রীয়াজ : আপনাকেও ধন্যবাদ