‘একটি সিনেমার প্রধান বস্তু হচ্ছে স্বরূপ বা প্রতিমূর্তির প্রবাহ। এই স্বরূপের সৌন্দর্য ও মহত্ত্ব প্রকাশে অন্য কোনো ভাষা প্রয়োগের প্রয়োজন পড়লে, তাহলে তা অযোগ্যতাই প্রমাণ করবে। স্বর মাধুর্যের, স্বর প্রবাহের গভীরতা যদি কোনো শব্দ ছাড়াই সংগীতের দ্বারা সম্ভব হয়; তাহলে স্বচ্ছ সৌন্দর্যবোধ সম্পন্ন অভিজ্ঞতা ধরলে দোষ কী?’ ১৯২৯ সালে মুরারী ভাদুরীকে লেখা একটি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর চলচ্চিত্র ভাবনা এবং উদ্ভাবনী সত্তার প্রকাশ এভাবেই করেছিলেন। পরে অনেক চিঠি ও নিবন্ধে চলচ্চিত্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন চিন্তা এবং পরিকল্পনার কথা আমরা জানতে পারি, যা বাংলা চলচ্চিত্রের নান্দনিক প্রবাহকে গতিশীল ও পরিশীলিত করেছে। প্রথম ইউরোপ সফর শেষে দেশে ফেরার পর চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ প্রবলভাবে জড়িয়ে পড়েন। কাহিনিকার, গীতিকার, চিত্রনাট্য, সংলাপ রচয়িতা এবং পরিচালক হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করেন এক ভিন্নমাত্রায়। তারই একপর্যায়ে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান নিউ থিয়েটার্সের ‘নটীর পূজা’ ছবিটি রবীন্দ্রনাথ পরিচালনা করেন। ১৯৩০ সালে নির্মিত মিঠু বসুর ‘গিরিবালা’ ছবিটি নির্মাণকাজে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। এ ছবির এক্সটাইটেল রবীন্দ্রনাথ নিজে রচনা করেন। পরে জার্মানি ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে রবীন্দ্রনাথ নিজের গল্প ‘ডালিয়া’ ও উপন্যাস ‘রাজর্ষি’ দুটো মিলিয়ে একটি চিত্রনাট্য রচনা করেন। ওই বছরের ২৬ জুলাই জার্মানির একটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা সংস্থার অনুরোধে ‘উফ দ্য চাইল্ড’ (যা রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক কবিতায় রূপান্তরিত নাম ‘শিশুতীর্থ’) নামে ইংরেজিতে একটি চিত্রনাট্য খসড়া রচনা করেন। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র গবেষক রজত রায় উল্লেখ করেন, ‘চলচ্চিত্র শিল্পের একেবারেই প্রাথমিক যুগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অসাধারণ শিল্প চেতনার দ্বারা বুঝতে পেরেছিলেন, চলচ্চিত্রের প্রধান জিনিসটাই হলো ঘটনার দৃঢ়তা, দৃশ্যের গতিপ্রবাহ বা রূপের চলৎপ্রবাহ। সংলাপ কিংবা কথার ভূমিকা তাতে গৌণ, গতিশীল চিত্রকল্প রচনাই হলো চলচ্চিত্রের প্রধান কাজ। উল্লেখ্য, বাংলা চলচ্চিত্রকারদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথই সর্বপ্রথম একটি মৌলিক ও সার্থক চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, একটি সাহিত্য-নিরপেক্ষ চিত্রনাট্য হিসেবে এর বিশেষ কোনো আলোচনা প্রায় হয়নি বলা চলে। অথচ রবীন্দ্রনাথ নিজেই মনে করতেন, তাঁর সংগীত যেমন এক বিশেষ ধারায় পরিচিতি লাভ করেছে, তাঁর গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রও এক বিশেষ রূপ লাভ করবে। নিরঙ্কুশভাবে রবীন্দ্রনাথের এ উপলব্ধির প্রকাশ সময়কালে যথাযথভাবে ঘটেছে। দেখা গেছে, বিভিন্ন বাস্তবতায় রবীন্দ্রনাথের ধ্রুপদী সব গল্প এবং উপন্যাস থেকে অজস্র চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে এবং এখনো এ ধারা অব্যাহত রয়েছে। আর ওইসব চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জড়িত কালজয়ী সব চলচ্চিত্রকার। যাদের মধ্যে নরেশ মিত্র, মিঠু বসু, সত্যজিৎ রায়, অজয় কর, তপন সিংহ, ঋত্বিক ঘটক, ঋতুপর্ণা ঘোষ উল্লেখযোগ্য। তাদের নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো হচ্ছে- গোরা, ঘরে বাইরে, কাবুলিওয়ালা, পোস্টমাস্টার, চারুলতা, চোখের বালি প্রভৃতি। ১৯৩৭ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার প্রমথেশ বড়ুয়া তাঁর ‘মুক্তি’ চলচ্চিত্রে সর্বপ্রথম রবীন্দ্রসংগীতকে চলচ্চিত্রে আনেন। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ নিজেই এ ছবির সংগীতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এরপর ১৯৩৮ সালে ‘গোরা’ ছবিতে সংগীত পরিচালক কাজী নজরুল ইসলাম অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীতকে সংযোজন করেন। তাঁর মৌলিকত্বে নজরুল যথেষ্ট প্রশংসিত হন। পরে বাংলা চলচ্চিত্রে নির্মাতারা অসংখ্য ছবিতে রবীন্দ্রসংগীত ব্যবহার করেন। রবীন্দ্রনাথের চলচ্চিত্র ভাবনা সম্পর্কে আজ এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, সাহিত্যের পাশাপাশি তিনি চলচ্চিত্র শিল্পেও যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন, যা যুগে যুগে, কালে কালে বাংলা চলচ্চিত্রের নান্দনিক ধারা বিভিন্নভাবে সমৃদ্ধ করবে। কারণ চলচ্চিত্র নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অনেক স্বপ্ন ও ভাবনা ছিল, যার সৌধ তিনি নিজেই নির্মাণ করে গেছেন। ১৮৬১ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের ৩৪ বছর পর ১৮৯৫ সালে চলচ্চিত্রের উদ্ভাবন হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য রবীন্দ্রনাথের নোবেল বিজয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সবার দৃষ্টি কাড়ে বাংলাসাহিত্য। ১৯২০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় প্রথম রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ গল্পের চলচ্চিত্রায়ণ করার উদ্যোগ নিলেও ১৯২৩ সালে নরেশচন্দ্র মিত্রের পরিচালনায় বাংলা চলচ্চিত্রে রবীন্দ্রসাহিত্যের প্রথম চিত্ররূপ ‘মান ভঞ্জন’। এরপর ১৯২৮ সালে শিশির ভাদুড়ি ‘বিসর্জন’ ও ‘বিচারক’ নামের দুটি ছবি নির্মাণ করেন। ১৯২৯ সালে ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় ‘তপতী’ ছবিটি নির্মাণ শুরু করলেও চার রিল পর্যন্ত শুটিং হয়। বিশ্বকবি নিজে কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয়ের জন্য রাজি হলেও বিদেশ ভ্রমণের কারণে ছবির কাজ অসমাপ্ত থেকে যায়। ১৯৩০ সালে ‘দালিয়া’ ও ‘গিরিবালা’ নামের দুটি সাহিত্যকর্মের চলচ্চিত্রায়ণ হয়। ১৯৩২ সালে সবাক চলচ্চিত্র ‘নটীর পূজা’ ও ‘চিরকুমার সভা’ মুক্তি পায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পরিচালিত একমাত্র চলচ্চিত্র ‘নটীর পূজা’। মাত্র চার দিনে ছবির শুটিং শেষ করেছিলেন তিনি। শান্তিনিকেতনের ছাত্রছাত্রীদের অভিনীত এ চলচ্চিত্রে উপালির চরিত্রে অভিনয় করেন রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং। এরপর নরেশ মিত্রের নির্বাক ছবি ‘নৌকাডুবি (১৯৩৮)’, সবাক ছবি ‘গোরা (১৯৩৮)’, সেতু সেনের ‘চোখের বালি (১৯৩৮)’ নির্মিত হয়। ২০০৩ সালেও ‘চোখের বালি’ বানিয়ে হইচই ফেলে দেন প্রয়াত নির্মাতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। রবীন্দ্রসাহিত্য নিয়ে তপন সিংহ পরিচালিত ‘কাবুলীওয়ালা’ ভারতের রাষ্ট্রপতির পদক, বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ১৯৬১ সালে চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় রবীন্দ্রনাথের তিনটি ছোটগল্প সমাপ্তি, পোস্টমাস্টার ও মনিহারা নিয়ে নির্মাণ করেন ‘তিনকন্যা’ ছবি। ‘তিনকন্যা’ ও ‘সমাপ্তির’ জন্য রাষ্ট্রপতি পদক, ‘পোস্টমাস্টার’ ও ‘সমাপ্তি’ শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে মেলবোর্ন ও বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে, ‘নষ্টনীড়’ গল্প অবলম্বনে চারুলতা (১৯৬৪) রাষ্ট্রপতি পদক, বার্লিন ও মেক্সিকো চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ ছবি ও ঘরে-বাইরে (১৯৮৪) ছবি ভারতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ও দামাস্কাস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার পায়।
বাংলাদেশে রবীন্দ্র চলচ্চিত্র
বাংলাদেশের ছবিতে রবীন্দ্রনাথের আগমন ঘটেছে ১৯৫৭ সালে এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর। সেটাও গান দিয়ে, গল্প বা উপন্যাস নয়। এর মধ্যে সালাউদ্দিন পরিচালিত ১৯৬৩ সালে ‘ধারাপাত’ ছবিতে একটি ও ১৯৭০ সালে জহির রায়হান পরিচালিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে একটি গান ব্যবহার করা হয় রবীন্দ্রনাথের। অবশ্য তার এক বছর আগে ১৯৬৯ সালে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ‘জোয়ার ভাটা’ ছবির ব্যাকগ্রাউন্ডে ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙামাটির পথ’ গানটি ব্যবহার করেন। ১৯৭২ সালে চাষী নজরুল ইসলাম তাঁর স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর নির্মিত ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে রবীন্দ্রনাথের ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা’ গানটি ব্যবহার করেন। সত্তর দশকের শেষদিকে সাইফুল আজম কাসেম ‘নৌকাডুবি’ উপন্যাসের ছায়া অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘সোহাগ’ ছবিটি। এ ছবিতে কাহিনিকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ১৯৮৪ সালে পরিচালক কাজী হায়াৎ ক্ষুধিত পাষাণ অবলম্বনে ‘রাজবাড়ী’ ছবিটি নির্মাণ করলেও ছবির টাইটেলে কাহিনিকার হিসেবে রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। চাষী নজরুল ইসলাম ২০০৫ সালে নির্মাণ করেন রবীন্দ্র উপন্যাস ‘শাস্তি’। একই বছর তিনি নির্মাণ করেন রবীন্দ্রনাথের গল্প অবলম্বনে ‘সুভা’। রবীন্দ্রসাহিত্যের সফল চলচ্চিত্রায়ণ ‘শাস্তি’ ও ‘সুভা’ দর্শকদের প্রশংসা কুড়াতে সক্ষম হয়। এরপর ২০০৬ সালে কাজী হায়াৎ নির্মাণ করেন ‘কাবুলীওয়ালা’। ২০১০ সালে নার্গিস আক্তারের পরিচালনায় রবীন্দ্রনাথের ‘সমাপ্তি’ গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয় ‘অবুঝ বউ’। চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের মতে, রবীন্দ্র রচনা নিয়ে এ দেশে আরও চলচ্চিত্র নির্মাণ হওয়া প্রয়োজন, কারণ তিনি হলেন বিশ্বকবি। তাঁর রচনায় বাঙালির নিত্যজীবনের পারিপার্শ্বিকতা জীবন্ত হয়ে ফুটে উঠেছে।