কয়েক দশক ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান সতর্কতার সাথে এমন একটা সীমারেখা অতিক্রম করাকে এড়িয়ে চলেছে যা সরাসরি সামরিক সংঘর্ষের দিকে এগিয়ে নিতে পারে।
আমেরিকা সম্ভবত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বিপজ্জনক যুদ্ধে জড়িয়ে যাবে এই আশঙ্কায়, একের পর এক আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এই ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে তাদের সামরিক শক্তি মোতায়েন করা থেকে বিরত ছিলেন।
এখন মার্কিন সর্বাধিনায়ক ডোনাল্ড ট্রাম্প, যিনি একজন শান্তিবাদী প্রেসিডেন্ট হওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তিনি তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক হামলা চালিয়ে সেই সীমারেখা অতিক্রম করেছেন।
এটা একজন প্রেসিডেন্টের দ্বিতীয় মেয়াদে নেয়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ যিনি কিনা সমস্ত পুরানো নিয়ম-নীতি ভঙ্গ করার জন্য গর্ব করে থাকেন।
এটি একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত যা বিশ্বজুড়ে রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সংস্কৃতির ভরকেন্দ্রগুলোতে আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।
ইরানের পরবর্তী পদক্ষেপ আরও তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে। দেশটির ৮৬ বছর বয়সী সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, যিনি এখন একটি বাঙ্কারে আশ্রয় নিয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে, তিনি তার সবচেয়ে শক্তিশালী শত্রুর বিরুদ্ধে একটা দীর্ঘ খেলায় সতর্কতার সঙ্গে প্রায় চার দশক পার করেছেন।
এটা তিনি করেছেন তার সবচেয়ে শক্তিশালী সম্পদ-ইসলামী প্রজাতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য।
যদি তিনি খুব কম কিছু করেন, তাহলে সম্মান থাকবে না। আর যদি বেশি কিছু করে ফেলেন, তাহলে সবকিছু হারাতে পারেন।
চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের পরিচালক সানাম ভাকিল বলেছেন, ‘খামেনির পরবর্তী পদক্ষেপগুলো হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এটা শুধু তার নিজের টিকে থাকার জন্যই নয় বরং ইতিহাসে তার নাম কীভাবে লেখা হবে সেটার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।’
ইরান-ইরাক যুদ্ধের ভয়াবহতা শেষে ইরানের প্রথম বিপ্লবী নেতার অনিচ্ছাসত্ত্বেও যুদ্ধবিরতি মেনে নেওয়ার তিক্ত সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার হাতে ধরা বিষপাত্রটি যেন সেই বিষের চেয়েও তীব্র, যা ১৯৮৮ সালে খামেনি অনিচ্ছায় পান করেছিলেন।’
‘এটা ইরানের কাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ নয়’
ইরাকের সাথে আট বছরের যুদ্ধে যে ক্ষতি হয়েছে, গত দশ দিনে, ইরানের চেইন অব কমান্ড এবং সামরিক সরঞ্জামের উপর ইসরায়েলের তীব্র হামলা তার চেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে, যেটা এখনও ইরানি সমাজে বড় প্রভাব রাখে।
ইসরায়েলি হামলার ফলে ইরানের নিরাপত্তা বাহিনীর শীর্ষস্থানীয় অনেক কর্মকর্তা এবং শীর্ষস্থানীয় পারমাণবিক বিজ্ঞানীরা নিহত হয়েছেন। এই সংঘাতে আমেরিকার প্রবেশ এখন চাপ বাড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৭৯ সালের ইরানি বিপ্লবের পর প্রতিষ্ঠিত ইসলামিক রেভোলিউশনারি গার্ড কর্পস (আইআরজিসি) দৃঢ়ভাবে সতর্ক করে দিয়েছে যে, তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এমন প্রতিশোধ নেবে যার ফলে তাদের ‘স্থায়ী অনুশোচনা’ হবে। কিন্তু বিপর্যয়কর ভুল এড়াতে তীব্র বাকযুদ্ধের আড়ালেও লুকিয়ে আছে জরুরি হিসাব-নিকাশ।
মিডল ইস্ট কাউন্সিল অন গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের হামিদরেজা আজিজ বলেন, ‘এটি এমন কোনো যুদ্ধ নয় যেটা ইরান চায়। তবে আমরা ইতোমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি, শাসকগোষ্ঠীর সমর্থকরা এমন যুক্তি তুলে ধরছেন যে-যুক্তরাষ্ট্র আসলে কতটা ক্ষতি করেছে তা বড় কথা নয়, বরং ইরানের শক্তিশালী রাষ্ট্র ও আঞ্চলিক ক্ষমতার যে ভাবমূর্তি ছিল, তা এতটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে যে, এর জবাব দেওয়া এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।’
তবে প্রতিটি প্রতিক্রিয়াই ঝুঁকিপূর্ণ। মধ্যপ্রাচ্যে প্রায় ২০টি মার্কিন ঘাঁটির যেকোনো একটিতে অথবা চল্লিশ হাজারেরও বেশি আমেরিকান সেনার যে কারো উপর সরাসরি হামলা সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ধরনের প্রতিশোধের সূত্রপাত ঘটাবে।
বিশ্বব্যাপী তেল পরিবহনের এক-পঞ্চমাংশের কৌশলগত জলপথ হরমুজ প্রণালী বন্ধ করে দিলে সেটাও হিতে-বিপরীত হতে পারে। কারণ সেটা এই অঞ্চলে আরব মিত্রদের পাশাপাশি ইরানি তেলের প্রধান গ্রাহক চীনকেও বিচলিত করে তুলতে পারে।
এই প্রধান ‘কৌশলগত স্থান’ রক্ষা করতে এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ধাক্কা এড়াতে পশ্চিমা নৌ শক্তিগুলিকেও টেনে নিয়ে আসা হতে পারে।
সেই সাথে এই অঞ্চল জুড়ে ইরানের যেসব প্রক্সি ও অংশীদারদের নেটওয়ার্ক আছে, ইরান যেটাকে ‘ফরোয়ার্ড ডিফেন্স’ হিসেবে বিবেচনা করেছিল, তার সবই গত বিশ মাসের যুদ্ধে ইসরায়েলি আক্রমণ এবং হত্যাকাণ্ডের ফলে দুর্বল বা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আমেরিকার ক্রোধ না বাড়িয়ে ইরানের পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্য কোনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প আছে কিনা তা স্পষ্ট নয়, যা উভয় পক্ষকে বিপদের দ্বারপ্রান্ত থেকে সরে আসার সুযোগ করে দেবে।
এই জটিল সম্পর্ক অন্তত একবার পরীক্ষা হয়েছিল।
পাঁচ বছর আগে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বাগদাদে ড্রোন হামলার মাধ্যমে আইআরজিসি কমান্ডার কাসেম সোলাইমানিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তখন অনেকেই আশঙ্কা করেছিলেন যে এটি একটি ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
কিন্তু ইরান ইরাকি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে মার্কিন ঘাঁটির কিছু অংশে তাদের পাল্টা আক্রমণের কথা জানিয়েছিল, যেটা মার্কিন কর্মীদের হত্যা বা উল্লেখযোগ্য ক্ষতি এড়ানো যায়। কিন্তু এই মুহূর্তটি তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
‘ইরান নয়, আমেরিকা কূটনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, যিনি বারবার ‘বোমা হামলার’ চেয়ে ‘ইরানের সাথে একটি চুক্ত ‘ করাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন, তিনি এখন দৃঢ়ভাবে ইসরায়েলের পক্ষে বলে মনে হচ্ছে।
তিনি ইরানকে ‘মধ্যপ্রাচ্যের দাঙ্গাবাজ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন, যে পারমাণবিক বোমা তৈরিতে আগ্রহী-যেটা এর আগের কোনো মার্কিন গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়নি।
গোয়েন্দা দলগুলো এখন পেন্টাগনের ভাষ্য অনুযায়ী ‘মার্কিন ইতিহাসের বৃহত্তম বি-২ অপারেশনাল স্ট্রাইক’-এর ফলাফল বিশদভাবে বিশ্লেষণ করছে। এটি ইরানের প্রধান পারমাণবিক স্থাপনা নাতাঞ্জ, ইসফাহান এবং ফোর্দোতে ‘অত্যন্ত মারাত্মক ক্ষতি এবং ধ্বংস’ ঘটিয়েছে।
পাহাড়ের গভীরে বানানো ফোর্দো স্থাপনায় কেবলমাত্র ‘বাঙ্কার বিধ্বংসী’ বোমাই প্রবেশ করতে পারতো।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এখন ইরানকে ‘শান্তিতে আসার’ আহ্বান জানাচ্ছেন। কিন্তু ইরান এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সমাধানকেও আত্মসমর্পণ হিসেবে দেখছে।
শুক্রবার জেনেভায়, যেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি তার ইউরোপীয় নেতাদের সাথে যে বৈঠক করেছিলেন, সেখানে তাকে একটি কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছিলো যে, ওয়াশিংটন আশা করে তেহরান তার পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ শূন্যে নামিয়ে আনবে।
এটি এমন একটি দাবি যা ইরান প্রত্যাখ্যান করে, কারণ এটি বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার সার্বভৌম অধিকারের লঙ্ঘন।
দেশটি এখন ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের নেতৃত্বে পরিচালিত পাঁচ ধাপের পরোক্ষ আলোচনাসহ সকল কূটনৈতিক প্রচেষ্টাকেই দেখে একটা বিশাল প্রতারণা হিসেবে।
মাসকটে ষষ্ঠ দফা আলোচনার দুই দিন আগে ইসরায়েল তার সামরিক অভিযান শুরু করে।
কূটনৈতিক সমাধানের সুযোগ দিতে আরও দুই সপ্তাহ সময় দিতে চান-প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এমন কথা বলার দুই দিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে প্রবেশ করে। এখন ইরান বলছে যে ইসরায়েল ও আমেরিকার বোমা যতদিন চলবে, তখন তারা আলোচনার টেবিলে ফিরে আসবে না।
আরাঘচি ইস্তাম্বুলে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ইরান নয়, বরং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কূটনীতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’
এই সময়, তিনি ৫৭ সদস্যের অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সাথে দেখা করেন যারা ‘ইসরায়েলের আগ্রাসনের’ নিন্দা করেন এবং ‘এই বিপজ্জনক উত্তেজনা বৃদ্ধির বিষয়ে তাদের গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেন।
ইরান আরও জোর দিয়ে বলতে চেষ্টা করেছে যে, তার ভূখণ্ডে আক্রমণ যেটা একইসঙ্গে জাতিসংঘ সনদ এবং আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার সতর্কবার্তা যে ‘প্রেক্ষাপট বা পরিস্থিতি যেটাই হোক’ পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে কখনও আক্রমণ করা উচিত নয়, তার লঙ্ঘন।
ইউরোপীয় নেতারা জরুরি ভিত্তিতে উত্তেজনা হ্রাস এবং ক্ষেপণাস্ত্রের পরিবর্তে মধ্যস্থতার মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার আহ্বান জানাচ্ছেন।
কিন্তু তারা এটাও জোর দিয়ে বলছেন যে ইরানকে পারমাণবিক বোমা অর্জনের অনুমতি দেওয়া যাবে না। তারা তেহরানের ৬০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণকে একটি অশুভ ইঙ্গিতের প্রকাশ বলে মনে করে। কারণ এটা অস্ত্র বানানোর মতো ৯০ শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের খুব কাছাকাছি।
‘ইরান সম্ভবত তার স্থাপনাগুলোর ক্ষতিকে ছোট করে দেখবে এবং জোর দিয়ে বলবে যে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি এই অভূতপূর্ব আক্রমণ থেকে বেঁচে গেছে,’ যুক্তি দেন ইউরোপীয় কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের মধ্যপ্রাচ্য এবং উত্তর আফ্রিকা প্রোগ্রামের উপ-পরিচালক এলি গেরানমায়ে।
‘এটা সম্ভব যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্ষতির পরিমাণকে বাড়িয়ে বলছে যেন ট্রাম্প আরও আক্রমণের মধ্যে জড়িয়ে না পড়ে সামরিক বিজয় দাবি করতে পারেন।’
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে এমন একদিকে টানছেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু, যার শক্তিশালী বাহিনী ইরানের ওপর আরও আঘাত হানতে থাকবে, ফলে ইরানের পাল্টা হামলার ঝুঁকিও বাড়বে।’
অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও ট্রাম্প চাপের মুখে পড়েছেন-কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই পদক্ষেপ নেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন আইনপ্রণেতারা, আর তার সমর্থকদের একাংশ মনে করছেন, দীর্ঘ যুদ্ধ থেকে আমেরিকাকে দূরে রাখার যে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছিলেন, তা তিনি ভঙ্গ করেছেন।
এই মুহূর্তটি ইরানের কট্টরপন্থী নীতিনির্ধারকদের সামনে একটি কঠিন প্রশ্ন তুলে ধরেছে-কীভাবে নিজেদের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে এড়িয়ে আবারও প্রতিরোধের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা যায়।
‘এটাই সবচেয়ে পরিহাস,’ সতর্ক করেন মিস গেরানমায়েহ। তিনি বলেন, ‘যদিও ট্রাম্প ইরানের পারমাণবিক হুমকি দূর করার চেষ্টা করেছেন, তিনি এখন ইরানের পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন।’
বিডি-প্রতিদিন/বাজিত