পাবনার ভাঙ্গুড়ায় ভয়াবহভাবে ছড়িয়ে পড়েছে মাদক ব্যবসা। ফেনসিডিল, ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজা ও দেশি মদ—সবই এখন হাতের নাগালে। দিন-রাতের কোনো পার্থক্য নেই, চাইলে সহজেই মিলছে এসব মাদকদ্রব্য। এতে কিশোর-তরুণ থেকে শুরু করে মধ্যবয়সী ও বয়স্করা জড়িয়ে পড়ছেন মরণনেশায়। এর প্রভাবে এলাকায় বেড়েছে চুরি, ছিনতাই, সংঘর্ষ ও পারিবারিক কলহ। আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে সাধারণ মানুষ।
স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রশাসনের উদাসীনতা এবং কিছু অসাধু পুলিশ সদস্যের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসা ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভাঙ্গুড়া পৌর এলাকা ও আশপাশের গ্রামে অন্তত ৫০টির বেশি স্থানে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি হচ্ছে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে—বড়াল ব্রিজ মাছবাজার, ভাঙ্গুড়া সিএনজি স্ট্যান্ড, চৌবাড়িয়া দক্ষিণপাড়া, ভদ্রপাড়া, কালীবাড়ি বাজার, পালপাড়া, আদর্শ গ্রাম, সারুটিয়া রেলগেট, জগাতলা বাজার, নৌবাড়ীয়া চাররাস্তা, শরৎনগর রেলস্টেশন, কৈডাঙ্গা রেলব্রিজ, অষ্টমনিষা ঘোষপাড়া, নুরনগর বাজার, শাহনগর ইটভাটা এলাকা, দিলপাশার রেলস্টেশন বাজার, খানমরিচের করতকান্দি ও চন্ডিপুর।
স্থানীয়দের দাবি, এসব স্থানে প্রতিদিনই মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের আনাগোনা থাকে। তারা টাকা জোগাড় করতে গিয়ে চুরি, ছিনতাই ও প্রতারণায় জড়িয়ে পড়ছে। গত এক মাসে উপজেলায় অন্তত ১০টি চুরির ঘটনা ঘটেছে, যার অধিকাংশই মাদকাসক্তদের সঙ্গে সম্পর্কিত বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
চলনবিল অধ্যুষিত শান্ত এই কৃষিপ্রধান উপজেলা এখন পরিণত হচ্ছে মাদক ব্যবসার ঘাঁটিতে। প্রতিদিন নতুন নতুন তরুণ এতে জড়িয়ে পড়ছে। অভিভাবকরা বলছেন, বিদ্যালয়গামী কিশোররাও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে, এতে শিক্ষাজীবন ধ্বংস হচ্ছে তাদের।
বেতুয়ান এলাকার এক অভিভাবক বলেন, ‘আমার ছেলে আগে ভালো ছাত্র ছিল, এখন তার চোখ লাল, সারাক্ষণ টাকা চায়। বুঝলাম ইয়াবায় আসক্ত হয়ে গেছে।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, মাদক ব্যবসার মূল হোতারা রাজনৈতিক প্রভাবশালী ও অর্থবান। তারা বিভিন্ন মহলকে ‘ম্যানেজ’ করে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। এক দোকানদার বলেন, ‘রাত নামলেই বড়াল ব্রিজ এলাকায় মাদক বিক্রি শুরু হয়, পুলিশ পাশ দিয়ে গেলেও কিছু বলে না।’
কালীবাড়ি বাজারের বাসিন্দা শান্ত ইসলাম বলেন, ‘আমরা যেমন জানি কারা এই ব্যবসা চালায়, প্রশাসনও জানে। কিন্তু বড় লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় না, ছোটখাটো বিক্রেতাদের ধরেই অভিযান দেখানো হয়।’
শরৎনগর বাজারের দোকানি আব্দুল জব্বার বলেন, ‘অভিযানের খবর আগেই ফাঁস হয়ে যায়, তাই আসল নিয়ন্ত্রকরা ধরা পড়ে না।’
উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব লিখন সরকার বলেন, ‘পুলিশের উদাসীনতার কারণেই মাদকের ভয়াবহতা বেড়েছে। আমরা নিজেরাই এক মাদক ব্যবসায়ীকে ধরে পুলিশের হাতে দিয়েছিলাম।’
উপজেলা কৃষক দলের সভাপতি আখিরুজ্জামান মাসুম বলেন, ‘মাসিক আইনশৃঙ্খলা সভায় একাধিকবার বিষয়টি জানানো হয়েছে, কিন্তু কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি। প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই ভাঙ্গুড়া এখন মাদকের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে।’
এ বিষয়ে সহকারী পুলিশ সুপার (চাটমোহর–ভাঙ্গুড়া–ফরিদপুর সার্কেল) আরজুমা আকতার বলেন, ‘মাদকের বিষয়ে কোনো ছাড় নেই। পুলিশ নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে এবং আমরা মাদক নির্মূলে বদ্ধপরিকর। বড় বা ছোট—যেই মাদক ব্যবসায়ী হোক, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে।’
পুলিশের কিছু সদস্য মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিচ্ছেন—এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘পুলিশের কারও অনৈতিক সুবিধা নেওয়ার সুযোগ নেই। যদি এমন অভিযোগ প্রমাণিত হয়, সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিডি প্রতিদিন/হিমেল