দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা দিনকে দিন ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। নারীনেত্রীরা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিকে এর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উদ্বেগজনক হলেও নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোকে সরকার সে অর্থে গুরুত্ব দিচ্ছে না। এসব ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর সরকারের নজরদারি না থাকায় এ ধরনের অপরাধ দমন করা যাচ্ছে না। এতে নারী ও শিশুর প্রতি হওয়া নির্যাতনের মাত্রাও আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। যে কোনো বয়সি নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না পাঁচ বছরের কমবয়সি কন্যাশিশুও। জানা যায়, গত কয়েক মাসের শিশু ধর্ষণের অর্ধেক ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। এতে ভুক্তভোগীরা বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে আর অপরাধীরা যৌন নির্যাতন করেও পার পেয়ে যাচ্ছে। সমীক্ষা বলছে, এ ধরনের অপরাধ ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সিরা বেশি করছে। একই অপরাধী বারবার এ ধরনের অপরাধ করছে। কারণ অপরাধীদের রাজনৈতিক ও ক্ষমতাসীনদের মদত পাচ্ছে। সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে ২৪ শতাংশ শিক্ষক ও ৩১ শতাংশ চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও বখাটে নারী ও মেয়েশিশুদের উত্ত্যক্ত করছে।
বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট এলিনা খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আশঙ্কাজনক। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না হওয়ার কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বেশি ঘটছে। অপরাধ দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সে অর্থে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ‘নিষ্ক্রিয়ভাবে তৎপর’। তাদের কোনো নজরদারি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের এমনো নারী উপদেষ্টা আছেন যারা রাজপথে বিভিন্ন সময়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পরও এখন দায়িত্বে থেকে নারী নির্যাতন দমনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। তাদের কাছ থেকে বড় বড় বক্তব্য ছাড়া আর কিছু দেখতে পারছি না। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসা পর্যন্ত এসব নির্যাতনে লাগাম টানা যাবে না। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে ৩৬৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়। আর সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ১২৩ জন নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৪ জনকে। বিভিন্ন নির্যাতনের জন্য আত্মহত্যা করেন ছয়জন। এ সময় স্বামীর নির্যাতনের শিকার হন ১৭ জন। ১৩৩ জন নারীকে তাদের স্বামীরা নির্যাতন করে হত্যা করেন। এ ছাড়া ১১৪ জন নারী বিভিন্ন নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেন। এ সময় ১২৩ জন নারী ও শিশু উত্ত্যক্তের শিকার হন এবং উত্ত্যক্ততার কারণে আহত হন ৪৬ জন।
এদিকে শিশু ধর্ষণের ঘটনাও আশঙ্কাজনকহারে বৃদ্ধি পাওয়ায় মানবাধিকার সংস্থাগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আসক- এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে শিশু ধর্ষণের ঘটনা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৭৫ শতাংশ বেড়েছে। বছরের জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত মোট ৩০৬ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর আগে ২০২৪ সালের একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল ১৭৫। এ সময় ১৩ জন শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়। বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করে ৫৪ শিশু।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সমীক্ষায় বলা হয়েছে সব ধর্ষণ মামলার ৬০ শতাংশ ভুক্তভোগী ১৮ বছরের নিচের শিশু। আশঙ্কাজনক যে মেয়েশিশুর পাশাপাশি ছেলেশিশুরাও যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। মহিলা পরিষদের ‘বাংলাদেশ নারী ও কন্যা নির্যাতন : ২০২৪ সমীক্ষা’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় যে, ২০২৪ সালে যেখানে ২ হাজার ৫২৫টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ২০২৫ এর প্রথম ৬ মাসেই নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১ হাজার ৫৫৫টি। ১৮ বছরের কম বয়সি কন্যাশিশুরা ধর্ষণ, যৌন হয়রানি ও বাল্যবিয়ের মতো নির্যাতনের শিকার বেশি হচ্ছে। আর অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশনে খোঁজ জানায়, ২০২৪ সালে অ্যাসিড নিক্ষেপের মোট ঘটনা ঘটেছে ১৪টি। এতে মোট ২২ জন অ্যাসিডদগ্ধ হন। এর মধ্যে ৮০ শতাংশের বেশি নারী।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে নারী নির্যাতনের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি দেশে যখন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয় তখন তার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর আঘাত বেশি আসে। এ হিসেবে নারী-শিশুর ওপর আঘাত বেশি হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীরাও এখন বেশি উগ্র আচরণ করছে। এর মাধ্যমে যুবসমাজের সামাজিক বোধ কমে যাচ্ছে ফলে নারী ও শিশু নির্যাতন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সমীক্ষাতেও আমরা দেখেছি যে, নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা একবার যে অপরাধ করে সে বারবার একই অপরাধ করে। তিনি বলেন, সরকারে যারা এখন দায়িত্বে আছেন তাদের নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। কিন্তু এর কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এখন নির্যাতন দমাতে যা করা হচ্ছে তা ‘টোকেন’ হিসেবে করা হচ্ছে। দায়বদ্ধতা থেকে এসব ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করার দাবি জানান তিনি।