স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বিদেশি মিশনগুলোতে ই-পাসপোর্ট কার্যক্রমে আউটসোর্সিং কম্পানি নিয়োগের আয়োজন করতে যাচ্ছেন কর্তাব্যক্তিরা। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান বা নিয়মনীতি মানছেন না বলে অভিযোগ খোদ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির।
তাদের দাবি, এটি করা হলে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য তৃতীয় পক্ষের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। কম্পানির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। তাই কোম্পানিকে কাজ না দিয়ে মন্ত্রণালয়ের পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ের মাধ্যমে সম্পন্ন করতে মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার) খোদা বখস চৌধুরী ও সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনিকে ১৩ দফা সংবলিত স্মারকলিপি দিয়েছে তারা। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
নাম প্রকাশ না করে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী কল্যাণ সমিতির একাধিক নেতা জানান, ফ্যাসিস্ট আমলের আউটসোর্সিং কম্পানিগুলোই আবার ঘুরেফিরে কাজ পাচ্ছে। এই কোম্পানিগুলোকে কাজ দিতে কয়েক কোটি টাকার অবৈধ লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। আউটসোর্সিংয়ে না দিয়ে আমাদের জনবল বাড়িয়ে সেবার মান বাড়াক। সেটা না করে পাসপোর্টের মতো স্পর্শকাতর দলিলের তথ্য তৃতীয় পক্ষের হাতে তুলে দিতে তাঁরা এত মরিয়া কেন? তারা জাতীয় নির্বাচনের আগেই বড় ধরনের বাণিজ্য করতে চান।
বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (প্রতিমন্ত্রী পদমর্যাদার) খোদা বখস চৌধুরী ও সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি কেউই কথা বলতে রাজি হননি। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগ) মো. শামীম খান নিজ দপ্তরে বলেন, ‘আউটসোর্সিং কম্পানির সুবিধা-অসুবিধা দুটিই আছে। আমাদের কর্মকর্তারা বিদেশে গেলে দুই ঘণ্টা কাজ করে বাকি সময় ঘুরে বেড়ান। ভালো সার্ভিস পেতে আমরা আউটসোর্সিংয়ে যেতে চাচ্ছি। এখানে অন্য কোনো ব্যাপার নেই।’
স্মারকলিপিতে বলা হয়, বিদেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামোভুক্ত পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ের ই-পাসপোর্ট ও ভিসা সেবা কার্যক্রম আউটসোর্সিং কম্পানিকে দিতে নীতিমালা করা হচ্ছে।
বিদেশে কর্মরত লাখ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশির এবং বাংলাদেশে ভ্রমণে ইচ্ছুক বিদেশি নাগরিকদের উন্নত ও দ্রুত পাসপোর্ট ও ভিসা দিতেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আওতায় পাসপোর্ট ও ভিসা উইং সৃজন করা হয়। এই উইং অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে সেবা দিয়ে আসছে।
বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে কিছু মাফিয়া কম্পানি আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় এর দায়িত্ব পায়। আন্তর্জাতিক টেন্ডার কিংবা কোনো নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে দূতাবাসের পাসপোর্ট ও ভিসা উইংয়ের কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়ে এবং কম্পানিগুলো সেবার নামে প্রবাসীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভীষণ উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে তাঁরা ১৩টি কারণ উল্লেখ করেছেন স্মারকলিপিতে। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো :
ক. ই-পাসপোর্ট সেবা আউটসোর্সিংয়ে দেওয়া হলে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় গোপনীয় তথ্য থার্ড পার্টির নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে।
খ. আউটসোর্সিং কম্পানির হাতে সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব না থাকায় পাসপোর্টে নাম, বয়স, পিতা-মাতার নাম সংশোধন এবং জাতীয় পরিচয়পত্র/জন্ম নিবন্ধন সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে তারা আশানুরূপ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে প্রবাসীরা আরো ব্যাপক হয়রানির শিকার হবেন এবং একটি কম্পানির কাছে প্রবাসীরা জিম্মি হতে পারেন।
গ. এসব কম্পানিতে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়োগ দেওয়া হয়, ফলে দক্ষ, প্রশিক্ষিত ও জবাবদিহির আওতায় জনবল নিয়োগ করা সম্ভব হবে না।
ঘ. অতীতে বিভিন্ন কম্পানিকে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে পাসপোর্ট সেবার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা বিভিন্ন অনিয়মের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। এ ক্ষেত্রে সৌদি আরবে আইরিশ কম্পানির বিষয়টি অন্যতম।
ঙ. কম্পানিগুলো যথাযথভাবে সরকারি কোষাগারে অর্থ জমা দেয় না ও অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে থাকে।
চ. এদের শক্তিশালী সিন্ডিকেট থাকায় অনেক সময় দূতাবাসও তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে।
ছ. সরকারের কোনো অথরাইজড অফিসার না থাকার ফলে পাসপোর্টের মতো স্পর্শকাতর বিষয়, গোপনীয় তথ্য এবং প্রবাসীদের সেবাপ্রাপ্তির বিষয়টি যথাযথভাবে মনিটরিং করা সম্ভব হয় না।
জ. সরকারি অর্থে কেনা কোটি কোটি টাকার মেশিন এবং গুরুত্বপূর্ণ সার্ভার জনগণের সব গোপনীয় তথ্য তাদের অফিসে বা তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। এতে রাষ্ট্রীয় গোপনীয় গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বিনষ্ট/চুরির আশঙ্কা থাকে।
ঝ. আউটসোর্সিং কম্পানি ইচ্ছামতো যে কাউকে পাসপোর্ট দিতে ডেটা এনরোলমেন্ট করতে পারে। এতে রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশের নাগরিক নন, এমন লোকজনের পাসপোর্টপ্রাপ্তির আশঙ্কা থাকে।
ঞ. ই-পাসপোর্ট সেবাটি আউটসোর্সিং কম্পানিকে দেওয়া একটি চুক্তিবদ্ধ প্রক্রিয়া। চুক্তির মেয়াদ শেষে কম্পানি পরিবর্তন কিংবা বিভিন্ন কোম্পানির কাজ পাওয়ার প্রতিযোগিতা গড়ে ওঠার ফলে সেবাটি নির্বিঘ্নে এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে দেওয়ার ঝুঁকি থাকে। যেমন-মালয়েশিয়ায় নিয়োগকৃত ইএসকেএল কম্পানির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরও তারা উচ্চ আদালতে মামলা করে কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, যা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য অবমাননাকর ও অনভিপ্রেত।
সৌজন্যে- কালের কণ্ঠ।