বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার, ভোটাধিকার, গণতন্ত্রের যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা, সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংক্রান্ত রায়টি হচ্ছে তার সম্পূর্ণ বিপরীত। বরং রায়ের নামে জনগণের আকাক্সক্ষার বাইরে গিয়ে তিনি তার ব্যক্তিগত পছন্দ, ব্যক্তিগত মতামত জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। এই রায়ের অভিশাপ আজ পর্যন্ত আমরা ভোগ করছি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল শুনানিতে এ বক্তব্য দেন বিএনপির আইনজীবীরা।
প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চে মামলাটির শুনানি চলছে। গতকাল সপ্তম দিনের শুনানি শেষে আজ ফের দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আপিলের পক্ষে গতকাল শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও রুহুল কুদ্দুস কাজল।
শুনানির পর জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন সাংবাদিকদের বলেন, ‘শুনানিতে সর্বোচ্চ আদালত প্রশ্ন রেখেছিলেন, আইনের দৃষ্টিতে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় যদি আইনসম্মত না হয়, তবে সেই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে (রিভিউ) যে আবেদন করা হয়েছে, যা এখন আপিল হিসেবে শোনা হচ্ছে, তার ফয়সালা কী হবে? আমি বলেছি, দেশের সর্বোচ্চ আদালত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের সব দিক পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পুনর্বিবেচনা করার ক্ষমতা রাখে। এই রায়ের দুটি অংশ; একটি হচ্ছে, রায়ের সংক্ষিপ্ত আদেশ, যা উন্মুক্ত আদালতে ঘোষণা করা হয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘এই সংক্ষিপ্ত আদেশে বলা হয়েছিল, গণতন্ত্রের স্বার্থে পরবর্তী দুটি সংসদ নির্বাচন (দশম ও একাদশ) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে পারে। এই সংক্ষিপ্ত আদেশ হয়েছিল আপিল বিভাগের রুলসের ১০(২) বিধি অনুসারে উন্মুক্ত আদালতে। আর পূর্ণাঙ্গ রায়টি দেওয়া হয়েছিল সাবেক প্রধান বিচারপতি অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর। ফলে সংক্ষিপ্ত আদেশটিকে রায় হিসেবে ধরে পুনর্বিবেচনার আবেদন (যা এখন আপিল হিসেবে শুনছেন সর্বোচ্চ আদালত) পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এই ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের আছে। এতে আইনগত কোনো বাধা নেই।’ ব্রিফিংয়ে আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে সব ঘটনা উল্লেখ করেছেন, তা সম্পূর্ণভাবে তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা এবং ব্যক্তিগত বক্তব্য। এটি কোনো বিচারিক রায় হতে পারে না। উনি রায়ে বলেছেন সংসদ অত্যন্ত নিয়মতান্ত্রিকভাবে ত্রয়োদশ সংশোধনী পাস করেছেন। আবার বলেছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মাধ্যমে যেসব ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়া হয়, তাদের সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পর্ক থাকে না। তারা জনগণের প্রতিনিধি না। সুতরাং তাদের বাদ দিয়ে জনগণের প্রতিনিধি দ্বারা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কিংবা নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। আবার স্ববিরোধী হয়ে রায়ে বলেছেন, ৪২ দিন পর্যন্ত একটি অনির্বাচিত সরকার হতে পারে।’ ১৪ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে রায় দিয়েছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ। পরে এ রায় নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। খায়রুল হকের বিরুদ্ধে রায় পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। জুলাই অভ্যুত্থানে গত বছর শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১৪ বছর আগের বিতর্কিত রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে গত বছর ২৭ আগস্ট আবেদন করেন ‘সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক’-এর সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ ব্যক্তি। পরে ১৭ অক্টোবর আবেদন করেন বিএনপির মহাসিচব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এর পাঁচ দিন পর ২৩ অক্টোবর আরেকটি আবেদন করেন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। এ ছাড়া আরেকটি আবেদন করেন নওগাঁর রানীনগরের বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন। এরপর আরও দুটি আবেদন করা হয়।
রিভিউ আবেদনে আপিল করার অনুমতি দিয়ে আপিল শুনানি হবে, নাকি রিভিউ আবেদনেই চূড়ান্ত শুনানি হবে, এ নিয়ে দুই দিন শুনানির পর গত ২৭ আগস্ট সর্বোচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত জানান। ছয়টি আবেদনের মধ্যে একটি আবেদনে আপিলের অনুমতি দিয়ে চারটি আবেদন এর সঙ্গে যুক্ত করে দেন আপিল বিভাগ। অন্য আবেদনটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়ে শুনানির জন্য রেখেছিলেন সর্বোচ্চ আদালত। সেই ধারাবাহিকতায় গত ২১ আগস্ট শুনানি শুরু হয়।