জুলাই গণ অভ্যুত্থানের পর থেকে ঢাকার ক্রাইম জোন হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদপুর-আদাবর ও মিরপুর এলাকায় অপরাধ বাড়তে থাকে। একের পর এক খুন, ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনায় ওই এলাকার জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। মাদক কেনাবেচার জন্য ঢাকার এ দুটি এলাকার পরিচিতি রয়েছে। বিভিন্ন ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ বা ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারীসহ অন্য অপরাধীদের অপতৎপরতায় ওই এলাকার বাসিন্দারা সর্বদা আতঙ্কে থাকেন। জনমনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের যৌথ অভিযান শুরু হলেও কোনোভাবে দমানো যাচ্ছে না সন্ত্রাসীদের। দীর্ঘদিন ধরে মোহাম্মদপুর ও মিরপুর অপরাধপ্রবণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। সম্প্রতি আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এসব এলাকার সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো।
২৭ মে মিরপুরে প্রকাশ্যে এক ব্যবসায়ীকে গুলি করে ২২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। পরদিন পরকীয়ার জেরে পল্লবীতে দম্পতি খুনের ঘটনা ঘটে। একই দিন রাতে রূপনগরে পারিবারিক কলহের জেরে মা রাশেদা খাতুনের গলায় ধারালো ছুরিকাঘাত করে ছেলে রোমান। এতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় রাশেদার। এ ঘটনায় রোমানকে রূপনগর থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। ২৬ মে পল্লবীতে মেট্রো স্টেশনের নিচের ফুটপাতে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে এক যুবকের আইফোন ছিনিয়ে নেয় তিন দুর্বৃত্ত। এ ঘটনার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে ফেসবুকে। গত ১৬ এপ্রিল শাহ আলীর পাইনখোলা ঈদগাহ মাঠ এলাকায় ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে সাজ্জাদ হোসেন রাব্বি (২৫) নামে এক ইন্টারনেট ব্যবসায়ী গুলিবিদ্ধ হন। গত ১৭ মার্চ শাহ আলীতে মাদকের টাকার ভাগাভাগি নিয়ে খুন হন আওয়াল হোসেন রনি নামে এক যুবক। গত ৪ নভেম্বর রাত ১০টায় পল্লবীর ১১ নম্বরের অ্যাভিনিউ-৪ এর সবুজবাংলা গেটে একটি সেলুনে হামলা চালিয়ে লুটপাট করে কিশোর গ্যাং উজ্জ্বল গ্রুপ। এ গ্রুপের সদস্য রকিসহ কয়েকজন সেলুনটিতে হামলা চালানোর সময় সেখানে রাজীব নামের এক প্রবাসী অবস্থান করছিলেন। উজ্জ্বল গ্রুপের সদস্যরা ওই প্রবাসীর কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে না পেয়ে তার ওপর হামলা চালায়। মোহাম্মদপুর শেরশাহ রোডে মনির আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ীর অফিসে প্রবেশ করে চাঁদা চেয়ে প্রকাশ্যে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় তিনজন মুখোশ পরে মোটরসাইকেলে করে অফিসে এসে গুলি চালায়। এরপরও চাঁদা না দেওয়ায় ২৮ এপ্রিল দিনদুপুরে দুজন মোটরসাইকেলে এসে সেই আবাসন ব্যবসায়ীর বাসায় ফের গুলি চালায়। ৩০ জানুয়ারি আদাবর ১০ নম্বর রোড বালুর মাঠ এলাকায় দিনদুপুরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে বাম হাতের কবজি বিচ্ছিন্ন হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন মো. সুমন শেখ নামে এক যুবক। মোহাম্মদপুরের শ্যামলী হাউজিং দ্বিতীয় প্রকল্প গত ৪ জানুয়ারি রাতে হানা দেয় একদল কিশোর গ্যাং। তারা সামনে যাকেই পেয়েছে কুপিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে সর্বস্ব। ওই এলাকার বিভিন্ন গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছেন হত্যাসহ বহু মামলার আসামি লেদু ও তার বাহিনী। পুলিশ বলছে, মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশ নিয়মিতই সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। গত দুই মাসে (এপ্রিল ও মে) সাঁড়াশি অভিযানে সহস্রাধিক অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে। ১ মে থেকে ২৮ মে পর্যন্ত মোহাম্মদপুর-আদাবর এলাকা থেকে ৪১৫ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছে খুন, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী, চুরি, মাদক, অস্ত্র আইন, পরোয়ানাভুক্তসহ অন্যান্য আসামি। ডিএমপির মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) এ কে এম মেহেদী হাসান বলেন, মোহাম্মদপুর-আদাবর একটি অপরাধপ্রবণ এলাকা। এখানে মাদক কারবার, ছিনতাই, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা নিত্য দিনের ঘটনা। আমরা এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করে জনমনে স্বস্তি দিতে সর্বদা তৎপর রয়েছি। নিয়মিত চেকপোস্ট, টহল টিম, সাঁড়াশি অভিযান চালানো হচ্ছে। ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ মাকছেদুর রহমান বলেন, মিরপুর এলাকার প্রতিটি অপরাধীর আলাদা তালিকা রয়েছে। সেই অনুযায়ী তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে কোনো অপরাধ সংঘটিত হলে অভিযুক্তদের দ্রুত আইনের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, অপরাধীর পার পেয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি যখন থাকে, তখন অপরাধ বাড়ে। আইনের দ্রুত প্রয়োগ না হলে ও আইনের শাসনের ঘাটতি থাকলে এগুলো সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।