মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থিত একটি আরব দেশ হলো সিরিয়া। পশ্চিম এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ একটি রাষ্ট্র এটি। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থান বলতে গেলে উত্তরে এরদোয়ানের তুরস্ক, দক্ষিণে জর্দান, দক্ষিণ-পশ্চিমে অভিশপ্ত ইসরায়েল, পূর্বে মুসলিম ভূখণ্ড ইরাক ও পশ্চিমে লেবানন। সিরিয়া প্রাচীন শামের একটি অংশ।
শাম শব্দটি একটি বিস্তৃত অঞ্চলকে বুঝায়। যা বর্তমান সিরিয়া, লেবানন, জর্দান ও পূর্ণ-ফিলিস্তিন (ইসরায়েলসহ) নিয়ে গঠিত।
শাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বরকতময় ভূমি। ইসলামের অতীত ইতিহাস ও ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে এই অঞ্চল।
এখানে আল্লাহ তাআলা অগণিত নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন। মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) নিজ সম্প্রদায়ের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়ে এখানে হিজরত করেছিলেন। হজরত ঈসা (আ.)-এর জন্মভূমি এটি। হজরত মুসা (আ.)-ও এখানে হিজরত করেছিলেন।
তাঁর জন্ম মিসর হলেও মৃত্যু হয় এখানে এবং তিনি কবরস্থ হন মসজিদে আকসার উপকণ্ঠে। এর বাইরেও হজরত ইয়াকুব (আ.), দাউদ (আ.) এবং সুলাইমান (আ.)-সহ সহস্র নবী-রাসুলের পদধূলিতে ধন্য এই ভূমি।
এক বর্ণনায় এসেছে, ‘আলী (রা.)-কে একবার শামের বিরুদ্ধে অভিশাপ দেওয়ার জন্য বলা হলো। কিন্তু তিনি অস্বীকৃতি জানিয়ে বললেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.) থেকে শুনেছি যে সেখানে আবদালরা (আল্লাহর বিশেষ বান্দা) থাকেন। তাঁদের সংখ্যা সব সময় ৪০ জন।
তাঁদের থেকে কেউ মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তাআলা অন্য একজনকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত বানান। এঁদের বরকতে বৃষ্টি হয় এবং কাফিরদের বিরুদ্ধে জয়লাভ হয়। ভবিষ্যতে এঁদের অসিলায় শামের অধিবাসীদের থেকে আজাব উঠিয়ে নেওয়া হবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৮৯৬)
বরকতময় ভূমি : শাম এমন বরকতময় ভূমি, যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.) মেরাজে গমনের সময় যাত্রাবিরতি করেছিলেন। সেখানকার মসজিদে আকসায় মহানবী (সা.)-এর ইমামতিতে আগের সব নবী-রাসুল নামাজ আদায় করেন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত, যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি। যেন আমি তাকে কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ১)
অভিশপ্ত দাজ্জাল সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণ করলেও চারটি স্থানে যেতে পারবে না। সেগুলোর একটি হলো শামে অবস্থিত বাইতুল মুকাদ্দাস বা মসজিদে আকসা। (সিলসিলায়ে সহিহাহ, হাদিস : ২৯৩৪)
মুসলমানদের প্রথম কিবলা : শামে অবস্থিত মসজিদে আকসা হলো মুসলমানদের প্রথম কিবলা। মেরাজের সময় আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের জন্য পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করে দেওয়ার পর মহানবী (সা.) ও সাহাবায়ে কিরাম মসজিদে আকসার দিকে ফিরেই নামাজ আদায় করতেন। অতঃপর হিজরতের ১৭ মাস পর কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশসংবলিত আয়াত নাজিল হয় এবং মসজিদে হারাম অভিমুখে নামাজের আদেশ প্রদান করা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আকাশের দিকে (হে নবী) তোমার বারবার তাকানো আমি লক্ষ করি। অবশ্যই তোমাকে আমি এমন কিবলার দিকে ফেরাব, যা তুমি পছন্দ করো। অতএব, তুমি মসজিদে হারামের দিকে মুখ ফেরাও।’ (সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ১৪৪)
খলিফা মাহদির সঙ্গে যোগসূত্র : পৃথিবীতে যখন খলিফা মাহদির আত্মপ্রকাশ ঘটবে, তখন শাম থেকে নামধারী মুসলমানদের একটি দল তাঁকে হত্যা করতে মক্কার দিকে রওনা করবে। কিন্তু আল্লাহর গজবের মাধ্যমে মক্কা-মদিনার মাঝামাঝি ‘বাইদা’ নামক স্থানে তাদের ধসিয়ে দেওয়া হবে। অতঃপর এ সংবাদ শুনে শামের শ্রেষ্ঠ মুসলমানরা এসে খলিফা মাহদির হাতে বায়াত গ্রহণ করবেন। তখন থেকে ঈসা (আ.)-এর আগমন পর্যন্ত তিনিই হবেন সেনাপ্রধান। এরপর ঈসা (আ.)-এর আগমন হলে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেবেন এবং দাজ্জালকে শামে হত্যা করবেন। তখন খলিফা মাহদি হবেন সে সৈন্যদলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সেনা সদস্য। (আল মানারুল মুনিফ : ১৪৭)
দাজ্জালকে হত্যা : কিয়ামতের আগে কানা দাজ্জাল যখন পৃথিবীব্যাপী গোলযোগ সৃষ্টি করবে এবং ফিতনা ছড়িয়ে দেবে, তখন ঈসা (আ.) দামেস্কে অবতরণ করবেন এবং দাজ্জালকে খুঁজতে থাকবেন। শেষতক শামের লুদ নামক স্থানে তাকে খুঁজে বের করে হত্যা করবেন। এ প্রসঙ্গে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী অঞ্চল থেকে দাজ্জাল বের হয়ে পৃথিবীব্যাপী গোলযোগ সৃষ্টি করবে। হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা তখন নিজেদের ঈমানের ওপর অটল থাকবে।’ এরপর হাদিসের শেষদিকে তিনি বলেন, ‘অতঃপর আল্লাহ তাআলা মারিয়াম তনয় ঈসা (আ.)-কে দুনিয়ায় পাঠাবেন। তিনি দুজন ফেরেশতার কাঁধে ভর করে দামেস্কের পূর্ববর্তী অঞ্চলের শুভ্র মিনারের কাছে অবতরণ করবেন। তখন তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস যেসব কাফিরের গায়ে লাগবে, তারা মারা যাবে। এবং দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে খুঁজতে থাকবেন এবং শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ২৯৩৭)
কিয়ামত-পূর্ব সময়ে ভূমিকা : কিয়ামত-পূর্ব সময়ে শাম হবে ইসলামী পুনর্জাগরণের মূলকেন্দ্র। এ জন্য মহানবী (সা.) শেষ যুগের ফিতনার সময় শাম অঞ্চলে অবস্থান করতে বলেছেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিশ্চয় কিয়ামত-পূর্ব সময়ে হাজারামাওত (ইয়েমেনের একটি ঐতিহাসিক অঞ্চল) থেকে একটি অগ্নিকুণ্ড বের হবে এবং লোকদের একত্র করবে। সাহাবিরা বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! তখন আমাদের কী করতে নির্দেশ দেন? তিনি বলেন, তোমরা শাম অঞ্চলকে মজবুতভাবে ধরে রেখো।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২২১৭)
বিজয়ের সুসংবাদ : মহানবী (সা.) খন্দক যুদ্ধের সময় মুসলমানদের শাম বিজয়ের সুসংবাদ দিয়েছেন। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ—খন্দকযুদ্ধে সালমান ফারসি (রা.)-এর পরামর্শক্রমে পরিখা খননের সময় সাহাবিদের সামনে একটা বিশাল পাথর পড়ে, যা তাঁরা কোনোভাবেই ভাঙতে পারছিলেন না। বিষয়টি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জানানো হয়। তিনি একটি কোদাল হাতে নিয়ে পাথরে আঘাত করেন। এতে পাথর ভেঙে যায়। তখন তিনি বলেন, ‘আল্লাহ মহান। আমাকে শামের চাবিগুলো (বিজয়) দেওয়া হয়েছে। শপথ আল্লাহর! আমি এখান থেকে তার লাল প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি।’
(সুনানে কুবরা, হাদিস : ৮৮৫৮)
রাসুলের এই ভবিষ্যদ্বাণী হজরত আবু বকর (রা.) ও হজরত উমর (রা.)-এর যুগেই বাস্তবায়িত হয়েছিল। তখনই মুসলমানরা শাম বিজয় করে।
লেখক : মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া দারুস সুন্নাহ
রাজাবাড়ী, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা
বিডি প্রতিদিন/মুসা