মরিয়ম বেগম (ছদ্ম নাম) ৩৫ বছরের গৃহিণী, ভালোই চলছিল সংসার। হঠাৎ পড়ে গিয়ে পায়ের হাড়ে Fracture ধরা পড়ে। পরীক্ষা শেষে দেখা যায় সে আসলে ফুসফুস ক্যান্সারের রোগী, যা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে, সংকটাপূর্ণ অবস্থা। রোগীর মলিকুলার প্রোফাইল করে একটা টার্গেট পাওয়া গেল, সেই মতো Precision Treatment একটি মুখের ওষুধ (TKI) শুরু হয়। মাত্র ছয় মাসের মাথায় রোগী দিব্বি সুস্থ হয়ে হাঁটছেন। এমনকি PET CT তেও কোনো মেটাবলিক অ্যাক্টিভিটি নেই।
শায়লা রহমান (ছদ্ম নাম) ২০২০ সালে স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন, চতুর্থ পর্যায়ের ক্যান্সার, কেমোথেরাপি শুরু করতে গিয়ে বিপর্যয়। রিঅ্যাকশনের জন্য কেমো দেওয়া বন্ধ হয়ে গেল, সৌভাগ্যবশত হরমোন পজিটিভ রোগী ছিলেন। হরমোন ও টার্গেট ওষুধ শুরু হলো, এ অবধি সুস্থ আছেন।
করিম সাহেব (ছদ্ম নাম) অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, হঠাৎ করে তার লিভার ক্যান্সার ধরা পড়ে, ছড়িয়ে পড়েছে। তার ছেলেমেয়েরা বিদেশে থাকেন। তারা ভালো চিকিৎসা চান। এন্টিবডি ও ইমিউনো থেরাপি সমন্বয়ে চিকিৎসা শুরু হলো। এখনো ভালো আছেন প্রায় দুই বছর, মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনযাপন করছেন।
সোহাগ আহমেদ (ছদ্ম নাম) বয়স ২৫। থাকেন টেকনাফে, তিনি মলদ্বারের ক্যান্সারের অপারেশন করে এসেছেন, ঠিকমতো স্টেজিং হয়নি, মলিকুলার প্রোফাইলিং সম্ভব হয়নি, দু’একটি কেমোথেরাপি দেওয়ার পর থেকে তার অসুস্থতা বেড়ে গেছে। দামি টার্গেট থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি, রোগ ধরা পড়ার ছয় মাসের মধ্যে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
পূজা রানী (ছদ্ম নাম), ৩০ বছরের গার্মেন্ট কর্মী। ২ মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার, হঠাৎ করে তার স্টেজ-৪ ব্রেস্ট ক্যান্সার ধরা পড়ে। মলিকুলার প্রোফাইলে তার Her-2 পজিটিভ আসে, যার চিকিৎসা মূলত Trastuzumab নামে একটি দামি এন্টিবডি, যা তার আর্থিক সঙ্গতির মধ্যে ছিল না, প্রায় বছর দেড়েক যুদ্ধের পর রোগের সঙ্গে হার মানলেন এই নারী।
কামাল সাহেব (ছদ্ম নাম) Vocal cord ক্যান্সারে আক্রান্ত, আর্থিক সমস্যার কারণে LINAC Machine এ রেডিওথেরাপি দেওয়া সম্ভব হয়নি, ঢাকায় আসার কথা বলা হলেও লোকবলের অভাবে যেতে পারেননি। চিকিৎসা শেষ করার ছয় মাসের মাথায় রোগ ফিরে এসেছে। এরপর বছর খানেক হলো বিভিন্ন কেমোথেরাপি নিয়ে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি। অনেক কষ্টে তিনি বেঁচে আছেন। যদি একে বেঁচে থাকা বলে? গত ৪ ফেব্রুয়ারি পালিতহল বিশ্ব ক্যান্সার দিবস। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হল এ দিনটি। সারা বিশ্বে পাল্লা দিয়ে ক্যান্সার বাড়ছে, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে ২০৩০ সালে ২৬ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে এবং ১৭ মিলিয়ন মানুষ ক্যান্সারে মারা যেতে পারে। এমনটাই দাবি করছে পরিসংখ্যান। উন্নত দেশগুলো পাকস্থলী, লিভার ও জরায়ুর ক্যান্সার কমিয়ে এনেছে ইনফেকশন নিয়ন্ত্রণ ও ভ্যাক্সিনেশনের মাধ্যমে। পক্ষান্তরে আমাদের মতো দেশগুলোতে বায়ুদূষণ ও খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহারে মুটিয়ে যাওয়ার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৫ সালে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে বিশ্বব্যাপী ক্যান্সারের ৫০ শতাংশ সংগঠিত হয়। ২০০৭ সালে এটি ছিল ৫৫ শতাংশ, ২০৫০ সালে ৬১ শতাংশে উন্নীত হবে। ক্যান্সার প্রাদুর্ভাবের আরেকটি খারাপ দিক হলো কম বয়সে ক্যান্সার হওয়া এবং তৃতীয় বিশ্বে এর প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের মহিলাদের প্রধান ক্যান্সার স্তন ক্যানসার। এতে আক্রান্তের হারের অর্ধেকের বয়স ৫০ এর নিচে। পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এ দেশের মহিলাদের অকাল মৃত্যুর প্রধান কারণ স্তন ক্যান্সার। এ প্রবণতা রোধে গবেষণা ও সমন্বিত উদ্যোগ সময়ের দাবি।
অনেকে ক্যান্সারের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে গিয়ে অপরিসীম ব্যথায় দিনাতিপাত করছেন। এদেরও ব্যথা কমানোর চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু মরফিনের মতো ওষুধ সহজলভ্য নয়, এক হিসেবে দেখা যায়, সারা বিশ্বে উৎপাদিত মরফিন জাতীয় ওষুধের ৮০ শতাংশ ব্যবহৃত হয় উন্নত বিশ্বে। এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে এই ওষুধের সংকট প্রবল। ক্যান্সার চিকিৎসার পাশাপাশি পেলিয়েটিভ চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। বিশেষ করে যেসব রোগী জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে খুব কষ্টের সঙ্গে দিন যাপন করছেন।
আমাদের দেশের ক্যান্সারের চিকিৎসা ধীরে ধীরে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। সঠিক সময়ে নির্ভুলভাবে রোগ নির্ণয় এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মলিকুলার প্রোফাইলিং এবং PET CT-এর মতো পরীক্ষা সহজলভ্য নয়। আধুনিক রেডিওথেরাপি চিকিৎসা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম এবং ব্যয়বহুল। টার্গেটেড চিকিৎসা, যেমন ইমিউনোথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার, আমাদের দেশেও এখন এটি পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এর চিকিৎসা ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রতিটি ক্যান্সার রোগীর চিকিৎসা ব্যয় গড়ে পাঁচ লাখ টাকা। টার্গেটেড চিকিৎসা নিলে এটি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। ২০২৫-২০২৭ সাল পর্যন্ত বিশ্ব ক্যান্সার দিবসের উদ্দেশ্য প্রতিটি ক্যান্সার রোগীর পেছনের গল্পকে অনন্যতাকে মান্যতা দেওয়া। রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা যেন আশা-আকাক্সক্ষা, হতাশা- ক্ষোভ, আক্ষেপ-বিলাপ, শোক ও শক্তির সম্মিলন। ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে ফলাফল অনুকূলে আনা সম্ভব।
আমাদের দেশে আগামী ২০-২৫ বছর মেয়াদি একটি ক্যান্সার ম্যাপ তৈরি করে রোগের প্রাদুর্ভাব ভিত্তিক অঞ্চল আমরা চিহ্নিত করতে পারি এবং সেই অনুযায়ী চিকিৎসা সেবাকে বিকেন্দ্রীকরণ ও প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে পারি। তাহলে ক্যান্সার রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হবে। সমন্বিত উদ্দ্যেগে সরকারি ও বেসরকারি এবং অন্যান্য সবার সহযোগিতার মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ক্যান্সার চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা, গবেষণায় বিনিয়োগ করা এবং প্রতিরোধমূলক কর্মসূচি বেগবান করাই হওয়া উচিত আমাদের ক্যান্সার চিকিৎসার মূল্য উদ্দেশ্য “If a cancer treatment is not affordable and available to everyone then it may not bring desirable success"
ক্যানসার চিকিৎসার সাফল্য নির্ভর করে দ্রুত শনাক্তকরণ, সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা। ১৯০০ সালে কোনো একজন ক্যানসার রোগীর জন্য পাঁচ বছর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ছিল ৫ শতাংশ, ২০২৪ সালে এটি প্রায় ৭০ শতাংশ, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ। এমনকি চতুর্থ পর্যায়ের ক্যানসার এখন আধুনিক চিকিৎসা যেমন ইমিউনোথেরাপি, কার্টিসেল থেরাপির মাধ্যমে অনেকাংশে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব কিন্তু এ ধরনের চিকিৎসা ব্যবস্থা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে অনেকটা। আমরা বিশ্বাস করি, এ জাতির অমিত সম্ভাবনা রয়েছে, যে কোনো দুর্যোগের মতো ক্যানসারের সুনামিও আমরা সামাল দিতে পারব সমন্বিত প্রয়াসের মাধ্যমে। এ জন্য প্রয়োজন ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার খরচ সহনশীল পর্যয়ে আনার উদ্যোগ এবং যথাযথ প্রতিরোধ কর্মসূচি। এছাড়া এটাও মনে রাখতে হবে এসবক্ষেত্রে প্রতিকার নয় প্রতিরোধ সর্বদা উত্তম।
-ডা. আলী আসগর চৌধুরী
সহযোগী অধ্যাপক, ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল