লেখক, গবেষক ও মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতি বদরুদ্দীন উমর ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। গতকাল ঢাকার বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৪ বছর। বদরুদ্দীন উমর দীর্ঘদিন ধরে বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম জানান, শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে গতকাল সকালে তাঁকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে ১০টা ৫ মিনিটে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি জানান, সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য বদরুদ্দীন উমরের মৃতদেহ আজ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে। সেখানে সকাল ১০টা থেকে শ্রদ্ধা জানানো যাবে। বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে মা-বাবা ও ফুফুর কবরের পাশে বদরুদ্দীন উমরকে সমাহিত করা হবে। জানা গেছে, বদরুদ্দীন উমর মৃত্যুকালে স্ত্রী, দুই মেয়ে, এক ছেলেসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। তাঁর বড় মেয়ে লন্ডনে থাকেন। আজ তার দেশে আসার কথা। বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুর খবরে গতকাল হাসপাতালে ছুটে যান বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। বদরুদ্দীন উমরের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. মাহফুজ আলম, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপি, গণঅধিকার পরিষদ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, গণসংহতি আন্দোলন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, বাসদ (মার্কসবাদী), গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি, সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এক শোকবার্তায় বলেন, বদরুদ্দীন উমর ছিলেন প্রগতির সংগ্রামের উজ্জ্বল বাতিঘর। তিনি শুধু একজন তাত্ত্বিক ছিলেন না, ছিলেন একজন সংগ্রামী, যিনি আজীবন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছেন। তিনি ফ?্যা?সিবাদী ও স্বৈরাচারী সরকারের পরিবর্তনের জন্য গোড়া থেকেই গণ অভ্যুত্থানের কথা বলেছেন এবং জুলাই আন্দোলনকে উপমহাদেশের একটি অভূতপূর্ব গণ অভ্যুত্থানের স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর মৃত্যু জাতির জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এক শোকবার্তায় বলেন, বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এদেশের স্বাধীন বিবেকের এক প্রতীক। তিনি বারবার রাজরোষে পড়া সত্ত্বেও আদর্শ বাস্তবায়নে ছিলেন আপসহীনভাবে স্থির। কোনো ভীতি বা হুমকি তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি তাঁর কর্তব্যকর্ম থেকে। স্বৈরতন্ত্রকে উপেক্ষা করে তিনি তাঁর স্বাধীন মতামত প্রকাশে কখনোই কুণ্ঠিত হননি। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক শোকবার্তায় বলেন, রাজনীতির দুর্নীতিকরণের বিরুদ্ধে বদরুদ্দীন উমর ছিলেন এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ। বিদ্যমান রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে তাঁর মতো নির্ভীক মুক্তচিন্তার বুদ্ধিজীবীর বেঁচে থাকা খুব জরুরি ছিল। জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক শোকবার্তায় বলেন, ষাটের দশকে জাতীয়তাবাদ, ধর্ম ও রাজনীতি বিষয়ে তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব সময়ে সাংস্কৃতিক চেতনা গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে এবং স্বাধীনতার আন্দোলনে প্রভাব বিস্তার করে। বদরুদ্দীন উমর গণতন্ত্র, বাক্?স্বাধীনতা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বহু অবদান রেখেছেন।
এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব সালেহ উদ্দিন সিফাত স্বাক্ষরিত শোকবার্তায় বলা হয়, বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের বয়ান উৎপাদক ও সমর্থক মূলধারার বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের বিপরীতে বদরুদ্দীন উমর ছিলেন গণমানুষের পক্ষের চিন্তক ও রাজনৈতিক শক্তি। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ও নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল শোকবার্তায় বলেন, বদরুদ্দীন উমর জীবনের পুরোটা সময়জুড়ে অবিচল থেকেছেন প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, গণমুখী রাজনৈতিক কর্মকান্ডে।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিন আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষী হয়েছিলেন সদ্য প্রয়াত লেখক, গবেষক ও তাত্ত্বিক বদরুদ্দীন উমর। এ মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে জবানবন্দিও দিয়েছিলেন তিনি। অন্তর্বর্তী সরকার চলতি বছরের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য বদরুদ্দীন উমরকে মনোনীত করলেও তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর ভাষ্য ছিল, এর আগেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা থেকে তাঁকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়েছে, তিনি কোনোটিই গ্রহণ করেননি। ষাটের দশকে প্রকাশিত লেখক-গবেষক ও বামপন্থি রাজনীতিক বদরুদ্দীন উমরের তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) বাঙালি জাতীয়তাবাদের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তখন থেকেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে তাঁর বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। তিনি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। ১৯৬৮ সালে শিক্ষকতার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী। এক সময় পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে ছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল নামে একটি সংগঠন গড়ে সভাপতির দায়িত্ব নেন।