ক্রমেই জটিল হচ্ছে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি। নতুন করে গত কয়েক মাসে বাংলাদেশে এসেছে ১ লাখ ১৩ হাজার রোহিঙ্গা। আগে থেকে বাংলাদেশের গলার কাঁটা হয়ে চেপে বসা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে নতুন এ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার চাপ এসেছে। নতুন এ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা আশ্রয় দিতে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘ। এর সঙ্গে উৎকণ্ঠা বাড়িয়েছে রাখাইনের জন্য মানবিক করিডর দেওয়ার ‘নীতিগত সিদ্ধান্ত’। যথাযথ আলোচনা ও পর্যালোচনা ছাড়া হঠাৎ এই সিদ্ধান্তে কূটনৈতিক মহলেও আছে উদ্বেগ। পাশাপাশি প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার হুমকির শঙ্কায় এই করিডরের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রতিদিনই রোহিঙ্গারা আসছে। ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে আসতে আসতে এখন ভেরিফিকেশনের পর নতুন এই রোহিঙ্গার সংখ্যা এখন ১ লাখ ১৩ হাজারে এসে দাঁড়িয়েছে। তারা মূলত ক্যাম্পের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনদের বাসায়, বন্ধ থাকা স্কুল ও হাসপাতালে আশ্রয় নিয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার পক্ষ থেকে তাদের খাবার দেওয়া হচ্ছে। গত সপ্তাহে এদের ক্যাম্প করে আশ্রয় দিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রস্তাব দিয়ে চিঠি দিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর। বাংলাদেশের পক্ষ বারবার তাদের জায়গাস্বল্পতার কথা জানানো হয়েছে। রোহিঙ্গাসংকট বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই সমস্যা, এখন প্রত্যাবাসন আরও জটিল হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘রাখাইনের জন্য মানবিক করিডরের বিষয়ে আমাদের কিছুই জানা নেই। এটি কূটনৈতিক চ্যানেলের আলোচনা।’ জানা যায়, গত মার্চে বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের পর প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের রাখাইনের মধ্যে একটি মানবিক করিডর স্থাপনের প্রস্তাব দেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। মার্চ কিংবা এপ্রিলে রাখাইন রাজ্যে দুর্ভিক্ষ আসতে পারে, এমন শঙ্কায় এই করিডর চাওয়া হয়। গত রোববার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এই প্রস্তাবে ‘নীতিগত সম্মতি’র কথা বলেন। উপদেষ্টা বলেন, ‘নীতিগতভাবে আমরা রাখাইন রাজ্যে করিডরের ব্যাপারে সম্মত হয়েছি। কারণ এটি একটি মানবিক সহায়তা সরবরাহের পথ হবে। তবে আমাদের কিছু শর্ত আছে। সেই শর্ত যদি পালন করা হয়, অবশ্যই আমরা জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সহযোগিতা করব।’ করিডর বাংলাদেশের জন্য নিরাপদ হবে কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, ‘এটা মালপত্র যাওয়ার ব্যবস্থা; অস্ত্র তো আর নেওয়া হচ্ছে না।’ তাঁর এই বক্তব্যের পরই শুরু হয় আলোচনা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক এম শাহিদুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এই করিডর কেমন হবে, সেখানে কী করা হবে, এর সঙ্গে এর কোনো কিছুই স্পষ্ট হয়। এই করিডর ভালো হতেই পারে। কিন্তু এ নিয়ে বিস্তর স্টাডি করে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন আছে। করিডরের সম্পর্কে কোথাও কোনো আলোচনা নেই, কেউ কিছু জানে না। হঠাৎ করে নীতিগত সিদ্ধান্তের কথা বলা হলো। এটা আশ্চর্যজনক। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘আরাকানদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য যে করিডর তৈরি করার সিদ্ধান্ত, সেটি সব দলের মতামতের ভিত্তিতে নেওয়া উচিত ছিল। সরকারের দায়িত্ব ছিল সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা। কারণ আমরা রোহিঙ্গাদের নিয়ে এমনিতেই সমস্যায় আছি, আমরা কোনো যুদ্ধ চাই না, আমরা গাজায় পরিণত হতে চাই না।’ জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছেন, রাখাইনের সঙ্গে মানবিক করিডরের বিষয়টি স্পষ্ট নয়। এ বিষয়টি জাতির সামনে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ এর সঙ্গে অনেক নিরাপত্তার বিষয় জড়িত থাকতে পারে। করিডরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়েছে হেফাজতে ইসলামও। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মামুনুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশকে ব্যবহার করে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে, দেশপ্রেমিক শক্তি হিসেবে হেফাজতে ইসলাম কোনোভাবেই এটি সমর্থন করে না। এর নিন্দা জানায়। আমরা এর প্রতিবাদ জানাব।’
তবে ‘মানবিক করিডর’ নিয়ে জাতিসংঘ বা কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি বলে গতকাল জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। গতকাল বার্তা সংস্থা ইউএনবিকে তিনি বলেছেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই যে সরকার তথাকথিত মানবিক করিডর নিয়ে জাতিসংঘ বা অন্য কোনো সংস্থার সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। সরকার মনে করে, যদি জাতিসংঘের নেতৃত্বে রাখাইনে মানবিক সহায়তা পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাংলাদেশ লজিস্টিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত থাকবে। প্রেস সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ সংকটকালে অন্যান্য দেশকে সাহায্য করার ক্ষেত্রে বরাবরই উদাহরণযোগ্য ভূমিকা রেখেছে, যার সাম্প্রতিক উদাহরণ হলো মিয়ানমারে ভূমিকম্পের পর আমাদের সহায়তা।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, জাতিসংঘ-সমর্থিত মানবিক সহায়তা রাখাইনে স্থিতিশীলতা আনতে এবং শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরি করতে সহায়ক হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাখাইনে সাহায্য পাঠানোর একমাত্র কার্যকর পথ হলো বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে। এই পথ ব্যবহার করে সাহায্য পরিবহনে লজিস্টিক সহায়তা দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ নীতিগতভাবে সম্মত।’
তিনি বলেন, ‘রাখাইনে সহায়তা পাঠানোর বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি।’ যথাসময়ে বাংলাদেশে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে পরামর্শ করব বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব।
জানা যায়, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে পরের কয়েক মাসে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঢল নামে। নতুন-পুরোনো মিলিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশে এখন ১৩ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়ে আছে। নানা সময় নানান পর্যায়ে কথা হলেও গত আট বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি।