পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় করা মামলায় গ্রেফতার জওয়ানদের নিরপরাধ বলে দাবি করেছেন তাদের স্বজনরা। তারা ওই জওয়ানদের মুক্তির দাবিতে পদযাত্রা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনায় পৌঁছাতে চাইলে তা আটকে দেয় পুলিশ। বুধবার বেলা সাড়ে ১২টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শুরু হওয়া পদযাত্রাটি শাহবাগ মোড়ে পৌঁছালে তা পুলিশ আটকে দেয়। পরে তাদের পক্ষ থেকে নয় সদস্যের প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিতে যান।
পরে বিকাল পৌনে চারটা পর্যন্ত স্বজনরা শাহবাগ জাদুঘরের সামনে অবস্থান করার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফিরে যান। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর বলেন, কারাগারে থাকা ও চাকরিচ্যুত বিডিআর জওয়ানদের পরিবারের সদস্যরা এসে শাহবাগে অবস্থান নিলে শাহবাগ থেকে ঢাকা বিশ্বিদ্যালয়ের দিকে সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
এর আগে, ভোরের আলো ফোটার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার। চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের পুনর্বহাল এবং কারাগারে থাকা সদস্যদের মুক্তির দাবিতে মানববন্ধন করা হয় সেখানে। এই মানববন্ধনে সাবেক বিডিআর সদস্যদের পাশাপাশি কারাগারে থাকা পরিবারে লোকজন অংশ নেন। মানববন্ধনে স্লোগানে স্লোগানে প্রতিবাদ জানানো হয় বিগত সরকারের নানা সিদ্ধান্তের। বক্তব্যে ফুটে ওঠে গত ১৫ বছরের ক্ষোভ আর নির্যাতনের কত শত গল্প।
বিডিআর পরিবারের সদস্যরা বলেন, তৎকালীন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার নীলনকশার অংশ হিসেবেই ২০০৯ সালে পরীক্ষিত সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা করা হয়। একইসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে ফাঁসানো হয় বিডিআর সদস্যদের। সমাবেশ থেকে বিডিআর সদস্যদের বিরুদ্ধে করা বিস্ফোরক মামলায় সবার জামিনের পাশাপাশি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কারাগারে থাকা সদস্যদের মুক্তির আল্টিমেটাম দেওয়া হয়। বেলা বাড়তেই দাবিগুলোর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে সমাবেশে অংশ নেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাও।
তারা বলেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দিনটিকে সেনা হত্যা দিবস ঘোষণা করতে হবে। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রে বিডিআর সদস্যদের দাবিগুলো অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও করেন তারা। এরপর পূর্বঘোষিত কর্মসূচী হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দিতে তার বাসভবন যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা শুরু করেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকার পিলখানায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সদর দফতরে বিদ্রোহের ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জন নিহত হন। এই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু'টি মামলা হয়। হত্যা মামলায় খালাস বা সাজাভোগ শেষে বিস্ফোরক মামলার কারণে ৪৬৮ জনের মুক্তি আটকে যায়।
জানা যায়, হত্যা মামলায় ৮৫০ জনের বিচার শেষ হয় ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। তাতে ১৫২ জনের ফাঁসি, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন ও ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। ২০১৭ সালের ২৭ নভেম্বর সেই মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের রায়ও হয়ে যায় হাইকোর্টে। তাতে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে। আরো ২২৮ জনকে দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে সাজা। খালাস পান ২৮৩ জন। হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৫৪ জন আসামি মারা গেছেন। হত্যা মামলায় হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২২৬ জন আসামি আপিল ও লিভ টু আপিল করেছেন।
এদিকে, হাইকোর্টে ৮৩ জন আসামির খালাস এবং সাজা কমানোর রায়ের বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায়। অন্যদিকে, বিস্ফোরক আইনের মামলায় ৮৩৪ জন আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়েছিল ২০১০ সালে। কিন্তু মাঝপথে বিস্ফোরক মামলার কার্যক্রম এক প্রকার স্থগিত রেখে শুধু হত্যা মামলার সাক্ষ্য উপস্থাপন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যে কারণে এই মামলার বিচার ঝুলে যায়।
ক্ষমতার পালাবদলের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার তদন্ত পুনরায় শুরুর দাবি উঠছে। গত ১৯ ডিসেম্বর অভিযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যান শহীদ পরিবারের সদস্যরা। পনের বছর আগে ওই হত্যাকাণ্ড পুনঃতদন্তের জন্য গত ২৪ ডিসেম্বর আ ল ম ফজলুর রহমানকে প্রধান করে কমিশন গঠন করে ৯০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছে সরকার।
বিডি-প্রতিদিন/শফিক
