বাংলা নববর্ষের বর্ণাঢ্য উদ্যাপন আমাদের ঐতিহ্যের অনুষঙ্গ। আর বাংলা বর্ষপঞ্জি আমাদের সংস্কৃতির এক মৌলিক উপাদান। বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের সূচনা। বহু শতাব্দীর ঐতিহ্যমণ্ডিত বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস খুব স্পষ্ট না হলেও এ কথা ঠিক যে, বাংলা সন গণনায় কোনো ঘটনা বা বিশেষ ব্যক্তি এর উৎস নয়। যেমনটি আমরা দেখতে পাই খ্রিস্টাব্দ গণনা যিশুখ্রিস্টের জন্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। আবার হিজরি সন গণনার উৎস মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মদিনায় হিজরত সম্পর্কিত। অত্যাসন্ন বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-এ কিন্তু এ কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না, যে বাংলা বর্ষ গণনার সূচনা ঠিক ১৪৩২ বছর পূর্ব থেকেই হয়েছে। বরং আরও অনেক আগে থেকেই এর প্রচলন ছিল। কারণ অনেক আগের রচিত সাহিত্যে বাংলা মাসের নামের উল্লেখ রয়েছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে গৌতম বুদ্ধ জন্মলাভ করেন। তাঁর জন্ম হয় বৈশাখী পূর্ণিমায়। এ থেকে বৈশাখ অনেক আগেই ছিল বলে ধারণা করা যায়।
সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক বিভিন্ন সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর সমন্বিত অবদানে সমৃদ্ধ বাংলার সংস্কৃতি। এতে যেমন বিশেষ কোনো ধর্ম প্রাধান্য পায়নি, তেমনই কোনো সম্প্রদায়ও একে প্রভাবিত করতে পারেনি। ইতিহাস থেকে জানা যায়, বাংলা বর্ষ গণনায় প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়েছে, সংযোজন হয়েছে এবং এর ফলে বাংলা বর্ষগণনা বর্তমানে এক পরিচ্ছন্ন ও বিজ্ঞানভিত্তিক রূপ লাভ করেছে।
বাংলা সনের উৎপত্তির বিষয়ে অস্পষ্টতা বা ভিন্নমত থাকলেও অধিকাংশ পণ্ডিত ও গবেষকের মতে, বাংলা সনের সূচনা হয় মুঘল সম্রাট আকবরের শাসন আমলে। সম্রাট আকবর তাঁর সময়ের পণ্ডিত আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর প্রচেষ্টায় বাংলা বর্ষ গণনার সঙ্গে হিজরি সনের সমন্বয় করেন। এর ফলে প্রাচ্য ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সেতুবন্ধনের সৃষ্টি হয়।
সম্রাট আকবর যে বছর (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ মোতাবেক ৯৬৩ হিজরি) সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন, সেই বছর থেকে তাঁর শাসন আমলে প্রচলিত হিজরি সনকে সৌরসনের হিসেবে এনে বাংলা সন নতুন ধারায় প্রবর্তন করেন। সৌরসন বা সৌরবৎসর হয় ৩৬৫ দিনে। আর চান্দ্রসন বা চান্দ্রবৎসর হয় ৩৫৪ দিনে। অর্থাৎ চান্দ্রসন (হিজরি) সৌরসন থেকে ১১ দিন কম। চলতি হিজরি সন ১৪৪৬ থেকে বর্তমানের সমাপ্তপ্রায় বাংলা সন ১৪৩১ বিয়োগ করলে পার্থক্য ১৫ বছরের এবং ক্রমেই এ ব্যবধান বেড়ে চলেছে।
বাংলা সনের বারো মাসে মোট ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা এবং অতীতে এই বারো মাসের সময়কালের বিন্যাস কিছুটা জটিল থাকায় তা অধিক ব্যবহারযোগ্য ও গণনা সহজতর করার লক্ষ্যে বাংলা একাডেমি ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ ১৩৭০ বঙ্গাব্দে জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে সভাপতি করে বাংলা বর্ষপঞ্জি পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটি ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রচলিত বাংলা সনের মূল কাঠামো ঠিক রেখে প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রস্তাব করে। এতে বাংলা বছরের প্রথম পাঁচ মাস ৩১ দিন ধরে এবং শেষের সাত মাস ৩০ দিন ধরে সময়কাল নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এভাবেই আমাদের বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করা হয় এবং তা তৎকালীন সরকার অনুমোদন করে, যা ১৯৮৮ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ ১৩৯৫ বঙ্গাব্দ থেকে কার্যকর করা হয়। ফলে বৈশাখ থেকে ভাদ্র পর্যন্ত প্রতিমাস ৩১ দিন এবং আশ্বিন থেকে চৈত্র পর্যন্ত প্রতিমাস ৩০ দিন করে গণনা করা হয়।
প্রতি চার বছর পরপর বাড়তি ৬ ঘণ্টার জন্য গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির অনুরূপে অধিবর্ষে (Leap Year) ফাল্গুন মাস হবে ৩১ দিনে অর্থাৎ ওই বারের বাংলা বর্ষপঞ্জি হবে অধিবর্ষ। এভাবে বাংলা সৌর সনের নিয়মতান্ত্রিকতার প্রবর্তন করা হয়। তবে আমাদের এই বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনাকে আরও সহজ করার জন্য ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ থেকে কিছুটা পরিবর্তন করা হয়। যার ফলে ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ অর্থাৎ ১৪২৬ বঙ্গাব্দ থেকে বাংলা বছরের প্রথম ছয় মাস ৩১ দিন ধরে এবং শেষের ছয় মাসের ফাল্গুন মাসকে ২৯ দিন ধরে বাকি পাঁচ মাস ৩০ দিন করে ধরা হয়। অর্থাৎ এখন বাংলা বর্ষপঞ্জিতে বৈশাখ থেকে আশি^ন পর্যন্ত প্রতি মাস ৩১ দিন এবং কার্তিক থেকে মাঘ পর্যন্ত ও চৈত্র মাস ৩০ দিন করে গণনা করা হয়। তবে কেবল ফাল্গুন মাস হয় ২৯ দিনে। আর প্রতি বছরের অতিরিক্ত ছয় ঘণ্টার জন্য চার বছর পর পর গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির মতো প্রতি অধিবর্ষে (Leap Year) ফাল্গুন মাস হয় ৩০ দিনে।
বাংলা মাসের নাম নক্ষত্রের নাম অনুকরণে রাখা হয়েছে। যেমন বিশাখা থেকে বৈশাখ, জ্যেষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ, উত্তরাষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদা থেকে ভাদ্র, অশ্বিনী থেকে আশ্বিন,কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, মৃগশিরা থেকে মাগশীর্ষ (অগ্রহায়ণ), পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, উত্তর ফালগুনী থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র নামকরণ করা হয়।
প্রাকৃতিক প্রভাবের কারণেই ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। যেভাবে এর ঋতুচক্রের বিন্যাস করা হয়েছে তাতে বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস হলো গ্রীষ্ম ঋতু, আষাঢ় ও শ্রাবণ বর্ষা, ভাদ্র ও আশি^ন শরৎ, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ মাস হেমন্ত ঋতু, পৌষ ও মাঘ মাস শীত এবং ফাল্গুন ও চৈত্র মাস হলো বসন্ত ঋতু।
আমাদের সংস্কৃতির ধারায় বাংলা বর্ষপঞ্জি ভাস্বর। যদিও নগর বা শহর জীবনে বাংলা বর্ষপঞ্জির ওপর তেমন নির্ভরতা নেই। কিন্তু গ্রাম বাংলার মানুষের জীবন প্রবাহে এর প্রভাব লক্ষণীয়। এই বর্ষপঞ্জির সূচনা হয় নববর্ষ বরণ উৎসব দিয়ে। এই নববর্ষ উৎসব বর্তমানে আমাদের জাতীয় চেতনার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে। তবে এর যে, প্রথম উৎসব ঘটেছিল বাংলার কৃষক সমাজের মধ্যে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এমনকি আজও বাংলা সন দেশের কৃষক সমাজের হৃদয়ে ভীষণভাবে গেঁথে আছে। মিশে আছে জীবনের সঙ্গে। তাঁদের কৃষিকাজ থেকে শুরু করে জীবন ধারণের প্রায় প্রতিটি কাজে বাংলা সন এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে, কোনো মাসের নাম বললেই সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট ফসলের কথা তারা ভাবেন। তাই তাদের বাংলা মাসের প্রতিটি তারিখ ও দিনের কথা গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখতে হয়। তারা জানেন কার্তিক মাসেই ডাল চাষ করতে হবে। দেরি হলেই ফসলের ক্ষতি হবে। আবার আষাঢ়-শ্রাবণ মাসের তারিখগুলো ধান চাষের বিভিন্ন পরিকল্পনার ছকে আবদ্ধ, কার্তিক-পৌষের দিনগুলোতে ফসল কেটে ঘরে তোলার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হয় (এখন অবশ্য গবেষণা করে বিভিন্ন ধরনের ধান উৎপাদনের জন্য বিভিন্ন মৌসুমে ধান চাষ করা হচ্ছে)। সেই সঙ্গে রয়েছে বারিধারার আকাক্সক্ষা, শীতলের অনুভূতি আর চলার পথের ছন্দ। তাই তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বপ্নময়, সম্ভাবনাময় বৈশাখকে স্বাগত জানিয়ে বলেন-
এসো হে বৈশাখ, এসো, এসো,
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষেরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা, দূর হয়ে যাক ...
আবার আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নতুন বছরের আগমনকে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনায় বরণ করতে গিয়ে বলেছেন-
তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশেখীর ঝড়। ...
বাংলা সনের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটে বর্ণিল নববর্ষ উদ্যাপন উৎসবে। তাই বাংলাদেশের মানুষ নববর্ষকে উপলক্ষ করে বৈশাখী মেলা, আনন্দ শোভাযাত্রা, নাচ-গান, কবিতা-সাহিত্য আসর, আলোচনা সভা ইত্যাদি অনুষ্ঠান আয়োজন করে। তাছাড়া নববর্ষের দিনে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে বিগত বছরের দেনাপাওনা মিটিয়ে নতুন বছরের হিসাবনিকাশের জন্য নতুন খাতা খুলতে হালখাতা উৎসবের আয়োজন করা হয়। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- দেশের ভূমিকর (খাজনা) বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে আদায় করা হয়। আবার বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ২৫ বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং ১১ জ্যৈষ্ঠ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মজয়ন্তী পালিত হয়। কিন্তু কেবল এই আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেই তো চলবে না। আজ সময় এসেছে, আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাংলা সনের প্রচলন ব্যাপকভাবে করতে হবে।
অবশ্য এ কথা ঠিক যে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বা বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের প্রশ্নে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করতে হয়। তবে স্বদেশের সব কর্মকাণ্ডে বাংলা সন প্রচলনের প্রশ্নে অহেতুক জটিলতার কথা বা আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের বাধার কথা না তুলে, সর্বস্তরে বাংলা সনের প্রচলনের উদ্যোগ নিতে হবে। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বাংলা সন এখন আর নিছক সংখ্যা নয়, বরং আমাদের জাতীয়তার বিকাশে ও সাংস্কৃতিক ধারার অগ্রযাত্রায় বাংলা সনের ব্যবহার আজ সময়ের দাবি। তাই দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, শিক্ষাবর্ষ ইত্যাদি সব ধরনের রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড বাংলা সন অনুসারে চালু হোক এই প্রত্যাশা করি।