শুষ্ক আবহাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে ভেড়ার তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। একসময় মরক্কোর পর্বতমালা, আলজেরিয়ার বিশাল মালভূমি এবং তিউনিসিয়ার সবুজ উপকূলজুড়ে ভেড়ার পাল চড়ে বেড়াতো। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব এবং ক্রমবর্ধমান খরচের কারণে এই অঞ্চলের মুসলিমরা যখন ঈদুল আজহা উদযাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তখন এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে।
প্রতি বছর মুসলিমরা আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের নিদর্শন হিসেবে ভেড়া কোরবানি করেন। এই প্রথা অনুযায়ী, নবী ইব্রাহিম তার পুত্রকে আল্লাহর উদ্দেশ্যে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন এবং তখন আল্লাহ একটি ভেড়া দিয়ে তার পুত্রকে প্রতিস্থাপন করেন। তবে, এই বছর ভেড়ার দাম বৃদ্ধি এবং সরবরাহ কমে যাওয়ায় নতুন চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি হয়েছে বলে এই অঞ্চলের পশু প্রজননকারী এবং সম্ভাব্য ক্রেতারা জানিয়েছেন।
গত সপ্তাহে আলজিয়ার্সের উপকণ্ঠে একটি বাজারে পশু প্রজননকারীরা ক্ষুব্ধ ক্রেতাদের বুঝিংয়েছেন যে,ভেড়া পালনের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু, যেমন - পশুখাদ্য, পরিবহন এবং পশুচিকিৎসার খরচ বেড়ে যাওয়ায় তাদের ভেড়ার দাম বাড়াতে হয়েছে।
স্লেইমান আওউদি নামের একজন ডাক্তার গত বছর কেনা ভেড়ার সাথে তুলনা করে বলেন, গত বছর আমি যে ভেড়া কিনেছিলাম, এটি দেখতে এবং ওজনে একই, কিন্তু এর দাম ৭৫ ডলার বেশি। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির মধ্যে, একটি ভেড়ার দাম ১,২০০ ডলারের বেশি হতে পারে, অথচ এই অঞ্চলে গড় মাসিক আয় ২৭০ ডলারের এর নিচে।
এই পরিস্থিতিতে মরক্কো এবং আলজেরিয়া নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছে।
আলজেরিয়ার কর্মকর্তারা এই বছরের শুরুতে অভ্যন্তরীণ ঘাটতি পূরণের জন্য ১০ লাখ ভেড়া আমদানির পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন। মরক্কোর বাদশাহ ষষ্ঠ মোহাম্মদ ঐতিহ্য ভঙ্গ করে মুসলিমদের ঈদুল আজহার কোরবানি থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। মরক্কোজুড়ে স্থানীয় কর্মকর্তারা পশুর বাজার বন্ধ করে দিয়েছেন, যাতে ক্রেতারা এই বছরের উদযাপনের জন্য ভেড়া কিনতে না পারে।
বাদশাহ মোহাম্মদ ষষ্ঠ, যিনি মরক্কোর সর্বোচ্চ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষও। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় টেলিভিশনে পাঠ করা একটি চিঠিতে লিখেছেন, আমাদের দেশ জলবায়ুগত ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যার ফলে পশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। এই কঠিন পরিস্থিতিতে কোরবানি করলে আমাদের জনগণের বড় অংশের বিশেষ করে সীমিত আয়ের মানুষের সত্যিকারের ক্ষতি হবে।
আলজিয়ার্স এবং এর আশেপাশের নতুন বাজারে হাজার হাজার ভেড়া আনা হয়েছে। তুলুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতিবিদ লোটফি ঘারনাউত রাষ্ট্রীয় সংবাদপত্র 'এল মৌজাহেদ'-কে জানিয়েছেন যে আলজেরিয়ার আমদানি কৌশলে ২৩০ থেকে ২৬০ মিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে এবং তাতেও সারা দেশের চাহিদা পূরণ নাও হতে পারে।
উত্তর আফ্রিকার যে অংশে জনসংখ্যা বাড়ছে এবং পশুপালন ও কৃষিকাজ ছাড়া চাকরির সুযোগ সীমিত, সেখানে অতিরিক্ত চারণের কারণে দীর্ঘকাল ধরে চাপ ছিল। কিন্তু সাত বছরের খরার পর, বৃষ্টিপাতের অভাব এবং পশুখাদ্যের আকাশছোঁয়া দামই এখন পশুর পালকে সংকুচিত করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খরার কারণে চারণভূমিগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যেখানে রাখালরা তাদের ভেড়ার পাল চরায় এবং কৃষকরা পশুখাদ্য হিসেবে শস্য উৎপাদন করে।
সরবরাহ কমে যাওয়ায় দাম বেড়ে গেছে, যা মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর নাগালের বাইরে চলে গেছে যারা ঐতিহাসিকভাবে কোরবানির জন্য ভেড়া কিনে থাকেন। মরক্কোর অর্থনীতিবিদ নজিব আকেসবি বলেছেন, পশুর পাল কমে যাওয়া সরাসরি চারণভূমির গাছপালা হ্রাসের ফল। দীর্ঘস্থায়ী খরা ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতিকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
আকেসবি যিনি হাসান দ্বিতীয় ইনস্টিটিউট অফ এগ্রোনমি অ্যান্ড ভেটেরিনারি মেডিসিনের প্রাক্তন অধ্যাপক, বলেন, উত্তর আফ্রিকার বেশিরভাগ পশুপালনই চারণভিত্তিক, যার অর্থ এটি সম্পূর্ণরূপে প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল, যেমন বন্য গাছপালা এবং বন, এবং বৃষ্টির জলে জন্মানো উদ্ভিদ।
তিনি আরও বলেন, পশু প্রজননকারীদের জন্য পশুপাল এক ধরনের ব্যাংক, যা তারা খরচ মেটাতে এবং ঋণ পরিশোধের জন্য বিক্রি করে। একটানা কয়েক বছরের খরা এবং পশুখাদ্যের ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের কারণে পশু প্রজননকারীদের সঞ্চয় কমে যাচ্ছে।
মরক্কোর ভেড়া ও ছাগল প্রজননকারী সমিতির সভাপতি আছরাফ মাজদুবি বলেছেন, প্রাকৃতিক গাছপালা কমে যাওয়ায় প্রজননকারীদের সম্পূরক পশুখাদ্যের জন্য বেশি খরচ করতে হচ্ছে। ভালো বছরে চারণভূমি ভেড়ার পালের প্রায় সমস্ত চাহিদা পূরণ করতে পারে, কিন্তু শুষ্ক বছরে তা প্রয়োজনীয় খাদ্যের অর্ধেক বা এক-তৃতীয়াংশে নেমে আসতে পারে।
তিনি বলেন, আমাদের বাকিটা খড় এবং বার্লির মতো পশুখাদ্য কিনে পূরণ করতে হয়। শুধু তাই নয়, বার্লি, খড় এবং আলফালফার দামও বেড়েছে- যার বেশিরভাগই আমদানি করতে হয়। মরক্কোতে, বার্লি এবং খড়ের দাম খরার আগে যা ছিল তার তিনগুণ, আর আলফালফার দাম দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
আছরাফ মাজদুবি বলেন, এই পেশার ভবিষ্যৎ খুবই কঠিন। প্রজননকারীরা শহর থেকে গ্রামে চলে যাচ্ছেন এবং কেউ কেউ আর ফিরে আসবেন না। এই সংকট উত্তর আফ্রিকার মুসলিমদের জন্য ঈদুল আজহার ঐতিহ্য পালনে একটি বড় বাধা তৈরি করেছে। ভেড়ার সরবরাহ এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা এই অঞ্চলের সরকারগুলোর জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সূত্র: আরব নিউজ
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল