গোধূলির আবছা আলোয় যখন ওয়াশিংটনের আকাশ কমলা আর বেগুনি রঙে সেজে উঠছিল, তখনো ক্ষমতার করিডোরে ফিসফাস চলছিল এক অভূতপূর্ব ভাঙনের। সে ভাঙন শুধু দুটি মানুষের নয়, দুটি ভিন্ন দর্শন এবং দুটি বিশাল সাম্রাজ্যের। একপাশে ডোনাল্ড ট্রাম্প, যার মুখর রাজনীতি আর অপরিকল্পিত বাগাড়ম্বর পুরো আমেরিকাকে দ্বিধাবিভক্ত করে রেখেছিল। অন্যপাশে ইলন মাস্ক, সিলিকন ভ্যালির স্বপ্নদ্রষ্টা, যার উদ্ভাবনী চিন্তা আর অস্থির মন মহাকাশ থেকে মাটির নিচে ছুটছিল। একসময় তারা ছিলেন একে অপরের জানে জিগার দোস্ত। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে সেই দোস্তি এখন তিক্ত দ্বন্দ্বে পর্যবসিত হয়েছে।
হোয়াইট হাউজের অন্দরে ক্ষমতার পালাবদল কেবল নতুন প্রশাসনই আনেনি, এনেছে এক নতুন ধরনের নাটকীয়তা। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসার পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক। একসময় তাদের সম্পর্ককে 'ব্রোম্যান্স' আখ্যা দেওয়া হয়েছিল, যা ছিল ট্রাম্পের 'ট্রুথ সোশ্যাল' এবং মাস্কের 'এক্স' (সাবেক টুইটার) প্ল্যাটফর্মে আলোচনার প্রধান বিষয়। তবে গত ১০ দিনে সেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নাটকীয়ভাবে রূপ নিয়েছে এক প্রকাশ্য দ্বন্দ্বে, যা ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক মহলে গভীর প্রভাব ফেলছে।
দ্বন্দ্বের শুরুটা হয় ট্রাম্পের প্রস্তাবিত নতুন কর ও ব্যয় সংক্রান্ত বিল নিয়ে। গত ২৮ মে সিবিএস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মাস্ক এই বিল নিয়ে তার হতাশা প্রকাশ করেন। বিলের কিছু দিক নিয়ে ট্রাম্প নিজেও 'খুশি নন' বলে জানালেও কর ছাঁটাইয়ের মতো কিছু অংশ নিয়ে তিনি ছিলেন উল্লসিত। তবে মাস্কের হতাশার মাত্রা এতটাই তীব্র ছিল যে, পরদিনই ২৯ মে তিনি সরকারি খরচ কমানোর জন্য গঠিত বিশেষ বিভাগ 'ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি (ডোজ)'-এর প্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান।
৩০ মে, মাস্ক তার শেষ কর্মদিবসে হোয়াইট হাউজে একটি সংবাদ সম্মেলনে কালশিটে চোখ নিয়ে হাজির হন। সেই দিনও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাকে প্রশংসায় ভাসিয়ে বলেছিলেন, মাস্ক আসলে বিদায় নিচ্ছেন না, তিনি হোয়াইট হাউজে ঘন ঘন আসা-যাওয়া করবেন। কিন্তু এই আপাত বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ দ্রুতই পাল্টে যায়।
২ জুন, ট্রাম্প তার আলোচিত অর্থনৈতিক বিল নিয়ে 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ পোস্ট করে দাবি করেন, তার বড়, সুন্দর বিল সম্পর্কে অনেক ভুল কথা ছড়ানো হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়ায় পরদিন, ৩ জুন, ইলন মাস্ক ওই বিলকে অতিরিক্ত খরুচে, লজ্জাজনক কাণ্ড এবং ঘৃণামুলক বিকৃতি বলে কড়া ভাষায় আক্রমণ করেন। সেদিন থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা বাড়তে শুরু করে।
৪ জুন, মাস্ক একটি নতুন ব্যয়বহুল বিলের আহ্বান জানান, যা যুক্তরাষ্ট্রের বাজেট ঘাটতি ও ঋণের সীমা বাড়াবে না। ওই দিন দুপুরে তিনি তার অনুসারীদের ট্রাম্পের বিলের বিরুদ্ধে কংগ্রেস সদস্যদের ফোন করে বিরোধিতা করার আহ্বান জানান।
পরদিন ৫ জুন, ওভাল অফিসে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মেৎর্সের সাথে সাক্ষাৎকালে ট্রাম্প বলেন, মাস্কের সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক ছিল কিন্তু এখন তা থাকার বিষয়ে তিনি অনিশ্চিত। তিনি অভিযোগ করেন, মাস্ক বৈদ্যুতিক গাড়ির ভর্তুকি কমানোর কারণে অসন্তুষ্ট যা টেসলা ও স্পেসএক্সের ব্যবসায় প্রভাব ফেলবে। ট্রাম্প আরও দাবি করেন, মাস্ক বিলের প্রতিটি বিষয় জানতেন এবং তিনি মাস্কের ওপর হতাশ।
ট্রাম্পের এই মন্তব্যের পরপরই মাস্ক তার এক্স অ্যাকাউন্টে একের পর এক পোস্ট দিতে থাকেন। ওভাল অফিস থেকে ট্রাম্পের সরাসরি প্রচারের সময় মাস্ক ট্রাম্পের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে লেখেন, মিথ্যা। আমাকে কখনো বিলটি দেখানো হয়নি, আর এটি রাতের অন্ধকারে এত দ্রুত পাস হয়েছে যে প্রায় কেউই কংগ্রেসে পড়েনি। তিনি বলেন, এই ভয়ংকর বিল বাজেট ঘাটতি ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাবে।
একই দিনে ট্রাম্প 'ট্রুথ সোশ্যাল' প্ল্যাটফর্মে মাস্ককে আক্রমণ করে বলেন, মাস্ক হোয়াইট হাউজে থাকতে থাকতে অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। তিনি হুমকি দেন, মাস্কের ইলেকট্রিক গাড়ির ম্যান্ডেট বাতিল করবেন, যার কারণে সবাই ইলেকট্রিক গাড়ি কিনতে বাধ্য হচ্ছিল। ট্রাম্প আরও লেখেন, আমাদের বাজেট বাঁচানোর সবচেয়ে সহজ উপায় হলো মাস্কের সরকারি ভর্তুকি ও চুক্তি বাতিল করা।
এই আক্রমণের জবাবে মাস্ক বিস্ফোরক অভিযোগ আনেন। বলেন, ট্রাম্প-এর নাম 'এপস্টাইন ফাইল'-এ উল্লেখ আছে। (এপস্টাইন ফাইলস হলো মার্কিন ফেডারেল কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সংকলিত নথির একটি সংগ্রহ যা যৌন অপরাধী জেফ্রি এপস্টাইনের অপরাধের তদন্তের সময় লিপিবদ্ধ হয়েছিল)।
তবে ট্রাম্প এতে দমে যাননি। তিনি 'ট্রুথ সোশ্যাল'-এ লেখেন, মাস্ক আমার বিরুদ্ধে যাই বলুক, আমি কিছু মনে করি না এবং তার বিলের পক্ষে অবস্থান ধরে রাখেন। তিনি পুনরায় জোর দেন যে, বাজেটের অর্থ সঞ্চয় করার সবচেয়ে সহজ পথ হলো ইলনের কোম্পানিকে দেওয়া কন্ট্রাক্ট ও ভর্তুকি বাতিল করা। এর জবাবে ইলন মাস্ক তৎক্ষণাৎ ড্রাগন স্পেসক্রাফট (আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যাওয়ার জাহাজ) বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দেন।
পরবর্তীতে, বিল আকম্যানের একটি মন্তব্য, যেখানে তিনি দু'জনকে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। সেটি শেয়ার করে মাস্ক কিছুটা নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত দেন এবং লেখেন, আপনি ভুল বলেননি।
তবে ট্রাম্প পিছু হটেননি। এবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প মাস্ককে একজন মানসিক ভারসাম্য হারানো ব্যক্তি বলে মন্তব্য করেন এবং বলেন, মাস্কের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ বিশেষ নেই।
এই দ্বন্দ্বের পরিণতি কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। একদিকে ট্রাম্পের ক্ষমতা, অন্যদিকে মাস্কের অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত প্রভাব– এই সংঘাত মার্কিন রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কী ধরনের ঢেউ তুলবে, তা সময়ই বলবে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল