কক্সবাজার সীমান্ত ঘিরে নতুন তৎপরতা শুরু করেছে আরাকান আর্মি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে হটিয়ে রাখাইন দখলে নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের ২৭০ কিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে আরাকান আর্মি। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর আরাকান আর্মি রাখাইন দখলে নেওয়ার পরপরই নাফ নদে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এরপর নিয়মিত বাংলাদেশি জেলে ও নৌযান অপহরণ করছে। তল্লাশির নামে সীমান্ত বাণিজ্যের পণ্যবাহী জাহাজ আটকে চাঁদা নিচ্ছে তারা। বাংলাদেশি জেলেদের অপরহরণ করে কখনো মুক্তিপণ নেয়, কখনো বা আহরিত মাছ, জাল ও জেলেদের নিত্যপণ্য সামগ্রী নিয়ে যায়। সম্প্রতি তারা জেলেদের আটক করে বাংলাদেশসংক্রান্ত স্পর্শকাতর বিষয়ে তথ্য জানতে চাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন ফেরত আসা জেলেরা। বলা যায়, সীমান্ত ঘিরে বহুমুখী তৎপরতা শুরু করেছে আরাকান আর্মি।
সম্প্রতি রাখাইন রাজ্যের অধিকৃত মংডু টাউনশিপে আরাকান আর্মির অবস্থানে হামলা চালাচ্ছে মিয়ানমারের আরেক সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এর প্রতিক্রিয়ায় আরাকান আর্মি মংডুর অভ্যন্তরে আরসার ঘাঁটিতে হামলা চালাচ্ছে। আরাকান আর্মি টেকনাফ সীমান্তে নাফ নদে টহল বাড়িয়েছে। মাছ ধরতে যাওয়া বাংলাদেশি জেলেদের নৌকাসহ অপহরণের ঘটনাও বেড়েছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি নাফ নদের টেকনাফ জেটিঘাট এলাকাসহ বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে চারটি ট্রলারসহ ১৯ জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। এর আগে ১০ ফেব্রুয়ারি নাফ নদের মোহনা-সংলগ্ন এলাকা থেকে দুটি ট্রলারসহ চার জেলেকে এবং গত বছর ১৬ নভেম্বর নাফ নদের উখিয়া উপজেলার পালংখালী সীমান্ত থেকে ছয় জেলেকে ধরে নিয়ে যায় আরাকান আর্মি। মিয়ানমারের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘আরসা সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা মুসলিম, আরাকানি ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা চালাচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনী আরসাকে সীমান্ত বরাবর অস্থিরতা সৃষ্টির নির্দেশ দিয়েছে। মিয়ানমারের অস্থিরতার প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরেও। সেখানকার রোহিঙ্গা নেতারা মনে করছেন, রাখাইন রাজ্যে অবস্থানরত কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। যদিও বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয়শিবিরে সাড়ে ১২ লাখ নিবন্ধিত রোহিঙ্গা রয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি সম্প্রতি কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করে বলেছেন, মিয়ানমারে সংঘাতের কারণে দেশটির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি খুবই জটিল আকার ধারণ করেছে। তা সত্ত্বেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারের পরিস্থিতি খুবই জটিল। সেখানে সংঘাত চলছে।’
সীমান্ত বাণিজ্যে বাধা : সীমান্তে মিয়ানমারের ২৭০ কিলোমিটার এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরপরই নাফ নদে মিয়ানমার অংশে নৌ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে তারা। এর প্রভাব পড়ে টেকনাফকেন্দ্রিক সীমান্ত বাণিজ্যে। কয়েক দফায় বাংলাদেশমুখী পণ্যবাহী কার্গো আটকে দেয় আরাকান আর্মির সদস্যরা। ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, নাফ নদে দেশটির জলসীমানা দিয়ে চলাচলকারী নৌযান থেকে কমিশন পেতে চায় আরাকান আর্মি! এ কারণে তারা পণ্যভর্তি কার্গো আটকে রাখার নজিরবিহীন ঘটনা ঘটিয়েছে। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট জিন্নাহ অ্যান্ড ব্রাদার্সের কর্ণধার শওকত আলী অভিযোগ করেন, আরাকান আর্মি ১০ শতাংশ কমিশন চায়।’ পরবর্তীতে কমিশন দিয়ে এসব পণ্যবাহী জাহাজ ছাড়া পেলেও ব্যবসায়ীরা আমদানি বিমুখ হয়ে পড়েছেন।
আরাকান আর্মির পর নৌবাহিনী : নির্দিষ্ট বিরতিতে নাফ নদে আরাকান আর্মি বাংলাদেশি জেলের অপহরণের পর এবার সেন্ট মার্টিন দ্বীপের অদূরে বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার সময় বাংলাদেশের জেলেদের ছয়টি ট্রলারে মিয়ানমারের নৌবাহিনী লুটপাট চালিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বুধবার সেন্ট মার্টিন উপকূলে মাছ ধরার সময় ছয়টি ট্রলারসহ প্রায় ৫৬ জেলেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার সকালের দিকে ছেড়ে দেন মিয়ানমারের নৌবাহিনীর সদস্যরা। ছেড়ে দিলেও ট্রলারের মাছ, তেল, জাল ও খাদ্যসামগ্রী সে দেশের নৌবাহিনীর সদস্যরা লুট করে নিয়ে গেছেন বলে অভিযোগ করেছেন ফিরে আসা জেলেরা। তারা জানান, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে জেলেরা মাছ ধরার সময় তাদের ট্রলারসহ মিয়ানমারের নৌবাহিনী সে দেশের জলসীমায় ধরে নিয়ে যায়। সেন্ট মার্টিনের ১০-১৫ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমার জলসীমানা থেকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ট্রলারের ১০-১২ লাখ টাকার রূপচাঁদা, ইলিশ, তেল, জাল ও খাদ্যসামগ্রী কেড়ে নিয়েছেন নৌবাহিনীর সদস্যরা। কয়েকজন জেলেকে মারধরও করা হয়েছে।
শাহপরীর দ্বীপ দক্ষিণপাড়ার ট্রলার মালিক সমিতির সভাপতি বশির আহমেদ বলেন, ‘জেলেরা নিরাপদে ফিরে এলেও ট্রলারে থাকা মাছ, জাল, তেল ও খাদ্যদ্রব্য কেড়ে নেওয়া হয়েছে।’
তথ্য চাওয়ার অভিযোগ : মুক্তিপণ দাবির বাইরে সম্প্রতি ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। তারা অপহৃতদের কাছে মুক্তিপণের পাশাপাশি বাংলাদেশের সীমান্তে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঘাঁটি ও অবস্থান জানতে চেয়েছে। এজন্য মারধর করা হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, ১ মার্চ কক্সবাজারের উখিয়ায় বিজিবির নতুন ব্যাটালিয়নের যাত্রা শুরু হয়েছে।
মিয়ানমার সীমান্ত নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লে. জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ১ মার্চ কক্সবাজারে প্রশাসনের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বলেছেন, দেশের সীমান্ত সুরক্ষা এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের স্বার্থে আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ঢাকা। তারা আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যাও জানতে চান। এরপর তারা জানতে চান বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় কোন কোন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঘাঁটি বা অফিস আছে।
সীমান্তে দিন দিন কিছু নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা যাচ্ছে জানিয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের টেকনাফ ব্যাটলিয়নের (২ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিকুর রহমান বলেন, বিজিবি সদস্যরা সীমান্তে সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। আরাকান আর্মির সঙ্গে যোগাযোগ রেখে অপহৃত জেলেদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে।’