মহানবী (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর সেখানে নতুন সমাজব্যবস্থার সূচনা করেন। এই সমাজের মূলকথা ছিল আল্লাহর সার্বভৌমত্ব, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সর্বজনীন নেতৃত্বের স্বীকৃতি, পারস্পরিক সহমর্মিতা, ধর্মীয় সহনশীলতা ইত্যাদি। একটি আদর্শ সমাজ বিনির্মাণে মহানবী (সা.) তার সাহাবিদের দীক্ষা, আত্মশুদ্ধি ও উত্তম চরিত্র গঠনে উৎসাহিত করেন। তার অবিরাম প্রচেষ্টায় সাহাবিরা ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসা, সম্মান, সম্ভ্রম, ইবাদত, আনুগত্য ও শিষ্টাচারের দীক্ষায় দীক্ষিত হন।
তারা নিষ্ঠার সঙ্গে আল্লাহ ও তার রাসুলের নির্দেশ মেনে চলতেন।
একজন সাহাবি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে জিজ্ঞেস করলেন, ইসলামের কোন দিকটি উত্তম? অর্থাৎ ইসলামের কোন আচার-আচরণটি উত্কৃষ্ট? তিনি বললেন, তুমি খাবার খাওয়াও, চেনা-অচেনা (লোককে) সালাম দাও। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬২৩৬)
আবদুল্লাহ বিন সালাম (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মদিনায় আগমন করেন, তখন আমি তার দরবারে হাজির হয়ে তার পবিত্র মুখমণ্ডল প্রত্যক্ষ করেই স্পষ্টত উপলব্ধি করলাম যে এ কমনীয়, রমণীয়, সুষমাস্নিগ্ধ ও উজ্জ্বলতামণ্ডিত মুখমণ্ডলটি কোনো মিথ্যুক মানুষের হতে পারে না। তার মুখনিঃসৃত যে প্রথম বাণীটি শ্রবণ করেছিলাম তা ছিল, হে লোক সকল! তোমরা পরস্পর পরস্পরকে সালাম দাও, খাদ্য খাওয়াও, আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় কোরো এবং রাতের বেলা মানুষ যখন নিদ্রাসুখে মগ্ন থাকবে তখন আল্লাহর ইবাদতে মশগুল থাকো।
নিরাপদে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস : ৩২৫১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, ‘সে ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না, যার প্রতিবেশী তার অন্যায়-অত্যাচার থেকে নিরাপদে না থাকে।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৪৬)
অন্য হাদিসে তিনি বলেছেন, ‘(প্রকৃত) মুসলিম ওই ব্যক্তি যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদে থাকে।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস : ২৬২৭)
মহানবী (সা.) প্রাত্যহিক জীবনে অন্যকে প্রাধান্য দেওয়ার শিক্ষা দিয়েছেন।
তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউই (প্রকৃত) মুসলিম হতে পারবে না যতক্ষণ না সে অপর ভাইয়ের জন্য ওই সব জিনিস পছন্দ করবে, যা নিজের জন্য পছন্দ করে।’(সুনানে নাসায়ি, হাদিস : ৫০১৭)
তিনি এভাবে সামাজিক ঐক্য ও সহনশীলতার শিক্ষা দিয়েছেন—‘সকল মুমিন একটি মানবদেহের মতো, যদি তার চোখে ব্যথা হয়, তাহলে সমগ্র দেহেই ব্যথা অনুভূত হবে, আর যদি মাথায় ব্যথা হয়, তাহলে তার সমগ্র শরীরেই ব্যথা অনুভূত হবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০১১)
তিনি আরো বলেছেন, ‘মুমিন মুমিনের জন্য একটি দালান ঘরের মতো, একাংশ অপর অংশকে শক্তি দান করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪৬)
তিনি একটি সহনশীল সমাজ গঠনের নিমিত্তে বলেছেন, ‘নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ রাখবে না, রাগ করবে না, একে অপর থেকে মুখ ফেরাবে না, আল্লাহর বান্দা ও আপসের মধ্যে ভাই ভাই হয়ে থাকবে। কোনো মুসলমানের জন্য হালাল নয় যে, সে তিন দিনের বেশি তার ভাইয়ের সঙ্গে ক্রোধবশত কথাবার্তা বন্ধ রাখবে না।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬০৭৬)
মহানবী (সা.) পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার প্রতি উৎসাহিত করে বলেছেন, ‘মুসলিম মুসলমানের ভাই, না তার প্রতি অন্যায় করবে আর তাকে শত্রুর হাতে অর্পণ করবে। আর যে ব্যক্তি আপন (মুসলিম) ভাইয়ের প্রয়োজন মেটাতে সচেষ্ট হবে আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটাতে থাকবেন। কোনো মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দুঃখ-কষ্ট দূরীভূত করে, তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। আর কেননা মুসলিম যদি তার মুসলিম ভাইয়ের দোষত্রুটি গোপন করে, তবে আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দোষত্রুটি গোপন রাখবেন।’ (সুনানে আবি দাউদ, হাদিস : ৪৮৯৩)
তিনি আরো বলেছেন, ‘সে ব্যক্তি মুসলিম নহে, যে পেটপুরে খায় অথচ তার পাশেই প্রতিবেশী অনাহারে কালাতিপাত করে।’ (আল আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ১১২)
এভাবে কোন ইবাদতের কী মর্যাদা ও আল্লাহর কাছে তার কী সাওয়াব ও পুরস্কার আছে সেসব তিনি আলোচনা করতেন। তাঁর নিকট কোনো আয়াত অবতীর্ণ হলে তিনি তা মুসলিমদের পড়ে শোনাতেন এবং পরবর্তী পর্যায়ে তাঁদের তা পড়ে শোনাতে বলতেন। উদ্দেশ্য ছিল এ কাজের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে বুঝ-সমঝ ও চিন্তাভাবনার উদ্রেক এবং দাওয়াতের যোগ্যতা ও সচেতনতার সৃষ্টি করা।
এভাবে রাসুলুল্লাহ (সা.) মুসলিমদের সুপ্ত সম্ভাবনাগুলোর পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের মাধ্যমে মনুষ্যত্বের সর্বোচ্চ স্তরে তাদের উন্নীত করেন এবং জাগতিক ও ঐশী ভাবধারার সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটিয়ে আল্লাহর চেতনা ও ন্যায়-নীতির প্রতি নিবেদিত ও সমর্পিত এমন এক মানবগোষ্ঠীর গোড়াপত্তন করেছিলেন, ইতিহাসে যার কোনো নজির নেই।
আধ্যাত্মিকতার অলৌকিক চেতনায় উজ্জীবিত প্রেরণাবোধ এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে নবী কারিম (সা.) মদিনার সমাজজীবনে এমন এক জীবনধারা প্রবর্তন করতে সক্ষম হয়েছিলেন, অখণ্ড মানবজাতির ইতিহাসে যা ছিল সর্বোচ্চ মানের এবং সর্বাধিক পূর্ণতাপ্রাপ্ত। এ জীবনধারায় তিনি এমন সব নিয়মনীতি এবং আচার-আচরণ প্রবর্তন করলেন, যা যুগ-যুগান্তর ধরে অব্যাহত থাকা শোষণ, শাসন ও নিষ্পেষণের অবসান ঘটিয়ে ছিল। জাঁতাকলে নিষ্পেষিত মানবজীবনকে শান্তি, স্বস্তি ও মুক্তির আস্বাদে ভরপুর করে তুলে এ জীবনধারার উপাদানগুলোকে এমন উঁচু মানের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূর্ণতা দান করা হয়েছিল যে যুদ্ধ এবং শান্তি সব অবস্থার সঙ্গেই সর্বাধিক যোগ্যতার সঙ্গে মোকাবেলা করে যেকোনো পরিস্থিতির মোড় নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার মতো যোগ্যতা মুসলিমরা অর্জন করেছিলেন। মুসলিমদের এমন পরিবর্তিত জীবনধারা কিছুটা যেন আকস্মিকভাবেই ইতিহাসের মোড় পরিবর্তন করে দেয়।
আর রাহিকুল মাখতুম অবলম্বনে
বিডি প্রতিদিন/মুসা