মানুষের জীবনে অর্থ-সম্পদ একটি অপরিহার্য অনুষঙ্গ। প্রতিদিনের জীবন পরিচালনায় অর্থের প্রয়োজন হয়। সমাজে সব মানুষের আর্থিক অবস্থা সব সময় তার অনুকূলে থাকে না। কখনো কখনো সমস্যা বা সংকটে পড়ে মানুষকে অন্যের কাছ থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিতে হয়।
এটাকে ঋণ বলা হয়। ঋণের আরবি প্রতিশব্দ কর্জ। এর বাংলা প্রতিশব্দ হলো ধার, দেনা বা হাওলাত। ইসলামী পরিভাষায় ঋণ হলো কেবল সহযোগিতার জন্য অন্যকে অর্থ-সম্পদ দেওয়া, যেন গ্রহীতা এর মাধ্যমে উপকৃত হয় এবং সে তার প্রয়োজন পূরণ করতে পারে এবং পরে নির্দিষ্ট সময়ে দাতাকে সেই অর্থ-সম্পদ কিংবা তার অনুরূপ ফেরত দেওয়া।
ইসলাম এ ধরনের ধার বা কর্জকে অনুমোদন দিয়েছে এবং এই ধরনের কাজকে অতি ফজিলত বা সওয়াবের বলে ঘোষণা করেছে। ইসলামে এই ঋণকে ‘করজে হাসান’ বা উত্তম ঋণ বলা হয়েছে। আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায়, সওয়াবের নিয়তে বিনা শর্তে কাউকে কিছু দিলে তাকে ‘করজে হাসানা’ বলা হয়।
কর্জ বা ধারের ফজিলত
মহানবী (সা.) নিজেই তাঁর প্রয়োজনের সময় ঋণ গ্রহণ করেছিলেন।
এমনকি তিনি অমুসলিম লোকের কাছ থেকেও ধার নিয়েছেন। তাই ইসলামী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কর্জে হাসানার অনেক গুরুত্ব ও ফজিলত রয়েছে। এ ধরনের কর্জকে ইসলাম শুধু উৎসাহিতই করেনি, বরং কর্জ বা ধারকে অনেক ফজিলতের কাজ বলে ঘোষণা করেছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই দানশীল নর-নারী, যারা আল্লাহকে উত্তমরূপে ধার দেয়, তাদের দেওয়া হবে বহুগুণ। তাদের জন্য আছে সম্মানজনক পুরস্কার।’ (সুরা : হাদিদ, আয়াত : ১৮)
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, ‘তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, জাকাত দাও এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ (কর্জ বা ধার) দাও।’ (সুরা : মুজাম্মিল, আয়াত : ২০)
আল্লাহ আরো বলেন, ‘আমি তোমাদের সঙ্গে আছি। যদি তোমরা নামাজ প্রতিষ্ঠা করো, জাকাত দিতে থাক, আমার পয়গম্বরদের প্রতি বিশ্বাস রাখ, তাদের সাহায্য করো এবং আল্লাহকে উত্তম পন্থায় কর্জে হাসানা দিতে থাক, তবে আমি অবশ্যই তোমাদের গুনাহ দূর করে দেব এবং অবশ্যই তোমাদের জান্নাতে প্রবিষ্ট করব, যেগুলোর তলদেশ দিয়ে নির্ঝরণীসমূহ প্রবাহিত হয়।’(সুরা : আল-মায়িদা, আয়াত : ১২)
কর্জ বা ধার অনেক ফজিলত ও উপকারিতার কাজ। তাই আল্লাহর রাসুল (সা.) তাঁর সঙ্গী সাহাবিদের প্রায়ই কর্জ বা ধার দিতে উৎসাহ দান করতেন। ধারের উপকারিতা সম্পর্কে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের অভাব পূরণ করবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার বিপদগুলো দূর করে দেবেন।’(সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৪৪২)
আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘প্রত্যেক ঋণই সদকাস্বরূপ।’ (বায়হাকি, হাদিস : ৩২৮৫)
ঋণ গ্রহণে সতর্কতা
ঋণ গ্রহণ ইসলামে বৈধ হলেও এটা যাতে পারতপক্ষে না নেওয়া হয়, সে ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে। কারণ ঋণ গ্রহণ করলে কথামতো সেটা যথাসময়ে পরিশোধ করা অপরিহার্য। তা না হলে অঙ্গীকার ভঙ্গ হবে। এর ফলে ঋণদাতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো কারণে ঋণ পরিশোধ করা না গেলে ঋণগ্রহীতা ভয়ানক ক্ষতির মধ্যে পড়বেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর পথে শহীদ হওয়া ব্যক্তিও তার ঋণের কারণে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস : ২২৪৯৩)
অন্যদিকে কেউ যদি সময়মতো তার ঋণ পরিশোধ করে তাহলে তাকে জান্নাত দেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তির মৃত্যু হবে অহংকার, খিয়ানত এবং ঋণ থেকে মুক্ত হয়ে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।’ (তিরমিজি, হাদিস : ১৫৭২)
সময়মতো ঋণ পরিশোধ না করার পরিণতি
ঋণগ্রহীতার জন্য এটা অন্যতম শর্ত যে সে অবশ্যই সময়মতো ঋণের অর্থ-সম্পদ পরিশোধ করে দেবে এবং সে তার ওয়াদা পূর্ণ করবে। কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণের ব্যাপারে আল্লাহ এবং রাসুল (সা.) অনেক ফজিলতের কথা বললেও, তা যদি সঠিকভাবে সঠিক সময়ে পরিশোধ করা না হয়, সে সম্পর্কেও কঠিন সতর্ক বার্তা রয়েছে। আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম যে তার (ঋণের) হককে উত্তমরূপে পরিশোধ করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ২৬০৬)
অক্ষম ব্যক্তিকে ঋণ পরিশোধে অবকাশ দেওয়া
সমাজে এমন অনেক লোক আছে, যারা নানা সমস্যার কারণে ঋণ গ্রহণ করে। তবে নানা পারিবারিক সমস্যা বা অক্ষমতার কারণে ঋণ সময়মতো কিংবা কোনোভাবেই পরিশোধ করতে পারে না। তাদের ঋণ পরিশোধ করতে অবকাশ দেওয়া, এমনকি সম্ভব হলে ঋণ মাফ করে দিতে ইসলাম ঋণদাতাকে উৎসাহিত করেছে। অক্ষম ব্যক্তির ঋণ পরিশোধে অবকাশ দেওয়া এবং সম্ভব হলে মাফ করে দেওয়াকে অফুরন্ত সওয়াবের কাজ বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, তাহলে তাকে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দাও। আর যদি ঋণ মাফ করে দাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্য আরো উত্তম, যদি তোমরা জানতে।’
(সুরা : বাকারাহ, আয়াত : ২৮০)
আল্লাহর রাসুল (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো অভাবী ঋণগ্রস্তকে সুযোগ দেবে অথবা ঋণ মাফ করে দেবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাকে তাঁর আরশের ছায়ায় আশ্রয় প্রদান করবেন। যেদিন তাঁর আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না।’
(তিরমিজি, হাদিস : ১৩০৬)
ঋণগ্রহীতার দোয়া
ঋণগ্রহীতা তার ঋণ পরিশোধ করতে তার মধ্যে যেমন আকাঙ্ক্ষা ও উদ্যোগ থাকতে হবে, তেমনি তা পরিশোধে সামর্থ্য দেওয়ার জন্যও আল্লাহর কাছে সাহায্য কামনা করতে হবে। আল্লাহর রাসুল (সা.) দেনা পরিশোধে তাওফিক কামনা করার শিক্ষা দিয়েছেন। দেনা বা ঋণ পরিশোধ করার চাপ থেকে যখন পেরেশানি বেড়ে যাবে, তখন আল্লাহর সাহায্য চাইতে হবে। এমন একটি দোয়া রাসুল (সা.) নিজে করতেন এবং তা করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি দোয়ায় বলেন, ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয়ই আমি আপনার কাছে দুশ্চিন্তা ও দুঃখ থেকে আশ্রয় চাই, অপারগতা ও অলসতা থেকে আশ্রয় চাই, কৃপণতা ও ভীরুতা থেকে আশ্রয় চাই এবং ঋণের ভার ও মানুষের দমন-পীড়ন থেকে আশ্রয় চাই।’
(সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩৬৯)
পরিশেষে
জীবন পরিচালনার কোনো না কোনো পর্যায়ে বিপদে পড়ে আমাদের ঋণ করা লাগতে পারে। ঋণ নিতে ইসলামে কোনো বাধা নেই। তবে ঋণের অর্থ-সম্পদ সময়মতো পরিশোধ করা মুমিনের অপরিহার্য দায়িত্ব। যে বা যারা ঋণ পরিশোধে গড়িমসি করবে, তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আবার ঋণগ্রহীতা যদি তার ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে অপারগ হয়, তাকে অবকাশ দেওয়া মানে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়িয়ে দেওয়া, এমনকি সম্ভব হলে তাকে মাফ করে দেওয়াকে আখিরাতে মুক্তির উপায় হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ঋণের ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হওয়ার তৌফিক দান করুন।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক, সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর, স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি.
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল