মদিনা রাষ্ট্রকে সুখ, শান্তি ও নিরাপদ রাখার জন্য মহানবী (সা.) সব ধর্ম, বর্ণ ও গোত্রের সমন্বয়ে একটি ঐতিহাসিক সনদ রচনা করেছিলেন। ওই সনদে যে ‘উম্মাহ’ কথাটি বলা হয়েছে তা ছিল সব ধর্ম-বর্ণের সমন্বয়ে রচিত উম্মাহ। মদিনা সনদের ২৬ অনুচ্ছেদে মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘বনু আউফের ইহুদিরা মুমিনদের সঙ্গে একই উম্মাহ। ইহুদিদের জন্য তাদের ধর্ম আর মুসলমানদের জন্য তাদের ধর্ম, তাদের মাওয়ালি বা আশ্রিত এবং তারা নিজেরাও। অবশ্য যে অন্যায় বা অপরাধ করবে সে নিজের এবং তার পরিবার-পরিজনেরই ক্ষতি করবে।’
ধর্মীয় ও গোত্রীয় এই বিভাজন ও বিরোধের অভিশাপ থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাখার জন্য কোরআনের নির্দেশনা হলো—‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য এবং আমার ধর্ম আমার।’
(সুরা : আল-কাফিরুন, আয়াত : ৭)
মদিনা সনদের মাধ্যমে মহানবী (সা.) সেই আদর্শ মুসলিম রাষ্ট্রে যে অভাবনীয় সুখ-শান্তির দুয়ার খুলে দিয়েছিল তার সুফল সবাই সমভাবে ভোগ করেছিল। মহানবী (সা.) ইহুদি, খ্রিস্টান ও অন্যান্য ধর্ম বা গোত্রের সঙ্গে যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন, তার মূল বিষয়বস্তু ছিল সবার ধন-সম্পদ, সামাজিক নিরাপত্তা, আদর্শ ও সম্ভ্রম রক্ষা করা এবং সবাই মিলে ঐক্যবদ্ধভাবে মদিনার স্থিতিশীলতা সংহত করা।
মদিনা সনদের শর্তগুলোর মধ্যে যেমন বলা হয়েছে : ১. অমুসলিমরা শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে মুসলমানরা তাদের রক্ষা করবে। ২. তাদের ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করা হবে না। ৩. তাদের সর্বপ্রকার নিরাপত্তা দেওয়া হবে। ৪. তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, সম্পত্তি ও অধিকারের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে।
৫. তাদের ধর্ম, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান ও গির্জা বা উপাসনালয়ের কোনো ক্ষতি করা হবে না। ৬. তাদের কোনো অধিকার ক্ষুণ্ন করা হবে না। ৭. তাদের বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী পাঠানো হবে না। ৮. ধর্মীয় ও বিচারব্যবস্থায় তাদের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হবে।
ইতিহাস সাক্ষী, প্রিয় নবী মুহাম্মদ (সা.) আরবের ইহুদি, খ্রিস্টান ও পৌত্তলিকদের হাতে বিভিন্ন সময় অপমানজনক হয়রানির শিকার হয়েছেন।
তারা মহানবী (সা)-এর ওপর বিভিন্ন সময় হামলা করেছে। তায়েফে ইসলাম প্রচার করতে গিয়ে মহানবী (সা.) বিরোধীদের পাথরের আঘাতে রক্তাক্ত হয়েছেন। এসব জাহেলের শাস্তির জন্য আল্লাহ ফেরেশতা পাঠিয়েছেন। অথচ মহানবী (সা.) তাদের ক্ষমা করে দেন, এমনকি তাদের কল্যাণের জন্য তিনি কায়মনোবাক্যে দোয়া করেন। মক্কার কাফির, মুনাফিক ও পৌত্তলিকরা মহানবী (সা.)-কে চরমভাবে অপমান-অপদস্ত করে মক্কা থেকে বের করে দিয়েছিল। অথচ তিনি তাদের এই হীন কাজের কোনো প্রতিবাদ করেননি; না তাদের কোনো কটু কথা বলেছেন।
এরপর মহানবী (সা.) যখন মক্কা জয় করলেন, তখন তাঁর হাতে একটি মানুষও খুন হলো না। কাফিরদের একটি বাড়িঘরও লুণ্ঠিত হলো না। এমনকি একটি ক্ষেত বা গাছের ফসলের ক্ষতি হলো না। মক্কা বিজয়ের দিনে মহানবী (সা.) মক্কাবাসী কাফিরদের সবাইকে সাধারণভাবে ক্ষমা করে দিলেন। উহুদের ময়দানে মহানবী (সা.) মাথায় আঘাত পেলেন, তাঁর দন্তমোবারক শহীদ হলো, তবু তিনি কারো ওপর প্রতিশোধ নেওয়া তো দূরের কথা তাদের একটি কটু কথাও বললেন না। একদিন মহানবী (সা.) দ্বিন প্রচারের কাজ করছিলেন। তখন কাফির কুরাইশরা তাঁর ওপর আক্রমণ করল। তাঁকে প্রহার করতে লাগল। এ সময় সাহাবি হারেস বিন আবু লাহাব (রা.) দৌড়ে এসে মহানবী (সা.)-কে রক্ষার চেষ্টা করেন। তখন কাফিররা তাঁর ওপর চড়াও হলো। এক কাফিরের তরবারির আঘাতে হারেস (রা.) শহীদ হলেন। তার পরও মহানবী (সা.) কাফিরদের অত্যাচারের জবাব দিলেন না। তিনি আপন কাজে অটল ও অবিচল রইলেন। আরেক দিন কাবাঘরে মহানবী (সা.) নামাজ পড়ছিলেন। এমন সময় কাফির উকবা চাদর দিয়ে মহানবী (সা.)-এর গলায় পেঁচিয়ে ধরল। এতে তাঁর দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। আবু বকর (রা.) এসে সেটি ছাড়িয়ে দিলেন। উকবা ও অন্য কাফিররা আবু বকর (রা)-এর ওপর হামলা করল। তার পরও তাঁরা কাফিরদের কিছুই বললেন না। মুখ বুজে সব সহ্য করলেন। আরেক দিন আবু জাহেল মহানবী (সা.)-এর মাথার ওপর বালু ছুড়ে মারল। মহানবী (সা.) তাতে ভ্রুক্ষেপ করলেন না। এভাবেই আল্লাহর রাসুল শত্রুদের নির্যাতন সহ্য করলেন, তবে তাদের প্রতি কোনো প্রতি-আক্রমণ করেননি।
একটি ইসলামী রাষ্ট্র বা সমাজে অমুসলিমরা সম্পূর্ণ নিরাপদ এবং সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বসবাস করার অধিকার রাখে। সে তার নিজস্ব ধর্ম ও বিশ্বাস রক্ষা করতে সক্ষম। কেননা, আল্লাহ তাআলা মানুষকে ধর্ম পালন করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘দ্বিন সম্পর্কে কোনো জবরদস্তি নেই। সত্য পথ ভ্রান্ত পথ থেকে সুস্পষ্ট হয়েছে। যে তাগুতকে অস্বীকার করবে এবং আল্লাহকে বিশ্বাস করবে সে এমন এক হাতল ধরবে, যা কখনো ভাঙবে না।’ (সুরা : আল-বাকারাহ, আয়াত : ২৫৬)
মহানবী (সা.) অমুসলিম বা সংখ্যালঘুদের স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপরে ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। অমুসলিম ও সংখ্যালঘুদের অধিকারের ব্যাপারে তিনি বলেছেন, ‘জেনো রেখো, যে মুসলমান কোনো চুক্তিবদ্ধ (অর্থাৎ অমুসলিম) নাগরিকের ওপর জুলুম করবে, তাদের অধিকার হরণ করবে, কিংবা তার ওপর সামর্থ্যের চেয়ে বেশি বোঝা চাপিয়ে দেবে, কিংবা তার কোনো জিনিস জোরপূর্বক ছিনিয়ে নেবে, সেই মুসলমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত অভিযোগে আমি আল্লাহর আদালতে অমুসলিম নাগরিকের পক্ষে দাঁড়াব।’
(আবু দাউদ)
ইসলাম অমুসলিম নাগরিক ও সংখ্যালঘু নাগরিকদের সব নিরাপত্তা বিধান করেছে। মহান আল্লাহ তাদের সঙ্গে ন্যায়পূর্ণ, স্বাভাবিক ও সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করার তাগিদ দিয়েছেন। আল্লাহ বলেন, ‘যারা দ্বিনের ব্যাপারে তোমাদের সঙ্গে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের বাড়িঘর থেকে বের করে দেয়নি, তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার ও ইনসাফ করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন না।’
(সুরা : মুমতাহিনা, আয়াত : ৮)
অমুসলিম বা সংখ্যালঘুর জানের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে ইসলাম। রাসুলুল্লাহ (সা)-এর সময়কালে একজন অমুসলিমকে একজন মুসলমান হত্যা করলে মহানবী (সা.) হত্যাকারী মুসলিমকে হত্যার নির্দেশ দেন। কারণ ইসলাম ধর্ম মতে, কাউকে হত্যা করা মানে গোটা মানবজাতিকে হত্যা করার শামিল। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো একজনকে হত্যা করল সে যেন দুনিয়ার সব মানুষকেই হত্যা করল। আর যে ব্যক্তি কারো প্রাণ রক্ষা করল সে যেন দুনিয়ার সব মানুষের প্রাণ রক্ষা করল।’ (সুরা : মায়িদা, আয়াত : ৩২)
লেখক : কথাসাহিত্যিক, সাবেক ডিএমডি, আইবিবিএল,
সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর,
স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক পিএলসি.