বহু বছরের গৃহযুদ্ধ ও শাসন পরিবর্তনের পর রবিবার মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় তাদের প্রথম সংসদীয় নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ফলাফল পাওয়া যায়নি।
দেশটির অন্তর্বর্তী সরকার পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে সমালোচিত হলেও এই নির্বাচনকে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে এক ‘সতর্ক সূচনা’ বলা হচ্ছে।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘর্ষের পর সিরিয়া এখন বাশার আল-আসাদ-পরবর্তী রাজনৈতিক রূপান্তরের পথে হাঁটছে। স্থানীয় কমিটির সদস্যরা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করেছেন। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সংসদ গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এই সংসদের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য সরাসরি নিযুক্ত করবেন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। বিশ্লেষকদের মতে, এটি হবে তার ক্ষমতাকে আরও সুসংহত করার পদক্ষেপ। অবশিষ্ট দুই-তৃতীয়াংশ আসন প্রাদেশিক ভিত্তিক ইলেক্টোরাল কলেজ বা নির্বাচনী পরিষদের মাধ্যমে নির্বাচিত হবে। সেখানে জনসংখ্যার অনুপাতে আসন বণ্টন করা হয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে বিপুল সংখ্যক নাগরিকের বাস্তুচ্যুতি ও পরিচয়পত্র হারানোর কারণে এখনই সরাসরি জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের আয়োজন সম্ভব নয় বলে অন্তর্বর্তী সরকার জানিয়েছে।
দামেস্কের জাতীয় গ্রন্থাগারে দেওয়া এক ভাষণে আহমেদ আল-শারা বলেন, অনেক আইন এখনও পাস হওয়ার অপেক্ষায় আছে। তা দেশের পুনর্গঠন ও সমৃদ্ধির পথে আমাদের এগিয়ে নেবে। সিরিয়া গড়া একটি সামষ্টিক দায়িত্ব- সব সিরিয়ানদের এতে অবদান রাখতে হবে।
অন্তর্বর্তী কর্তৃপক্ষ ক্ষমতায় আসার পর পুরনো সংসদ, যা মূলত ‘রাবার স্ট্যাম্প’ হিসেবে পরিচিত ছিল, তা বিলুপ্ত করে দেয়। নতুন ২১০ সদস্যের সংসদ- যার নাম পিপলস অ্যাসেম্বলি’র প্রধান কাজ হবে নতুন নির্বাচন আইন ও সংবিধান প্রণয়ন।
আয়োজক কমিটির তথ্যানুযায়ী, প্রায় ১৫০০ প্রার্থী এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। এর মাত্র ১৪ শতাংশ নারী। নতুন এই সংসদের মেয়াদ থাকবে ৩০ মাস। এটা পুনর্নবীকরণযোগ্য এবং এর মেয়াদকালেই ভবিষ্যৎ সাধারণ নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হবে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনও প্রার্থীই পূর্ববর্তী শাসনব্যবস্থার সমর্থক হতে পারবেন না এবং দেশের বিভাজন বা বিচ্ছিন্নতাবাদ প্রচার করতে পারবেন না।
প্রার্থীদের মধ্যে রয়েছেন সিরিয়ান-আমেরিকান হেনরি হামরা। তিনি ১৯৪০-এর দশকের পর প্রথম ইহুদি প্রার্থী হিসেবে ইতিহাস তৈরি করছেন। তবে দ্রুজ সম্প্রদায়-অধ্যুষিত সুয়েইদা প্রদেশে এবং কুর্দিশ নেতৃত্বাধীন সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সেস নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়েছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও দামেস্কের মধ্যে উত্তেজনার কারণে।
সমালোচকরা বলছেন, ইলেক্টোরাল কলেজ পদ্ধতি প্রভাবশালী ও সংযোগসম্পন্ন প্রার্থীদের সুবিধা দিতে পারে, যার ফলে অন্তর্বর্তী সরকার অন্যায্য সুবিধা পেতে পারে এবং কিছু জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বাদ পড়তে পারে। তবে অনেকের জন্য এই নির্বাচনটি ছিল অগ্রগতির প্রতীক।
দামেস্কের চিকিৎসক লিনা দাবুলকে নির্বাচনী কলেজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ জানানো হলে তিনি প্রথমে রাজি হননি। তিনি বলেন, পূর্ববর্তী সংসদগুলোর কুৎসিত চিত্রের কারণে এই দায়িত্ব নিতে ভয় পেয়েছিলাম।
কিন্তু পরে বুঝতে পারেন যে, তিনি কেবল ভোটারদের একজন হবেন, তখন তিনি একে ‘জাতীয় দায়িত্ব’ হিসেবে গ্রহণ করেন। ভোটের দিনে তিনি বলেন, এটাই আমার জীবনের প্রথম ভোট। আমি খুশি, দীর্ঘ লাইনেও দাঁড়াতে আমার কোনও আপত্তি নেই।
দামেস্কে জাতীয় নির্বাচন কমিটির সদস্য লারা ইজুকি বলেন, এই নতুন সংসদে সব সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব আছে। সিরিয়ার ইতিহাসে এটাই প্রথমবার, যখন ব্যালট বাক্স সত্যিই সিদ্ধান্ত নিচ্ছে- আগে থেকে ফল নির্ধারিত নয়।
অন্যদিকে, বাশার আল-আসাদের শাসনকালে সৈনিক হিসেবে কর্মরত থেকে ২০১১ সালে গণবিক্ষোভ ও সরকারি দমনপীড়নের পর সেনাবাহিনী ত্যাগ করা ইব্রাহিম হালাবি বলেন, আমাদের জীবনে এটাই প্রথমবার, যখন আমরা কোনও বাহ্যিক চাপ ছাড়া একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক নির্বাচনে অংশ নিচ্ছি।
উল্লেখ্য, আহমেদ আল-শারার নেতৃত্বাধীন ইসলামপন্থী জোট ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ নেয়। সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, আল-জাজিরা
বিডি প্রতিদিন/একেএ