ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র পেহেলগামে ২২ এপ্রিলের হামলার পর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র আকার ধারণ করেছে। এরই মধ্যে উভয় দেশ পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণায় বড় সংঘাতের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। এদিকে কাশ্মীর সীমান্তে ভারত ও পাকিস্তানের সেনাদের মধ্যে চতুর্থ দিনের মতো গোলাগুলির খবর পাওয়া গেছে। এতে এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৃহস্পতিবার থেকে প্রতি রাতেই কাশ্মীর সীমান্তে ভারত-পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি চলছে। এই হামলার জন্য পাকিস্তানকে দায়ী করে দেশটির বিরুদ্ধে একাধিক ব্যবস্থা নেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে ভারত। পাকিস্তানও জানিয়েছে, তারা সিমলা চুক্তিসহ ভারতের সঙ্গে সব চুক্তি স্থগিত করছে। তারপর থেকেই জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখে প্রতি রাতে গুলির লড়াই চলছে।
কাশ্মীর থেকে এক সাংবাদিক জানিয়েছেন, প্রতি রাত ১২টার পর গুলি চলছে। ভোরে থেমে যাচ্ছে। তবে শুধু গুলিই চলেছে। তিনি জানান, সীমান্তে প্রচুর সেনা মোতায়েন করছে ভারত। ব্যাপক মুভমেন্ট হচ্ছে। এমতাবস্থায় যে কোনো পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান প্রস্তুত বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। গতকাল পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যম ডনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। সোমবার রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খাজা আসিফ বলেন, আমরা আমাদের সেনাবাহিনীকে শক্তিশালী করেছি, কারণ পরিস্থিতি এখন তাৎক্ষণিক পদক্ষেপের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সে অনুযায়ী কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সরকারকে আগাম সতর্ক করেছে যে, ভারতের তরফ থেকে আক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে, তবে তিনি এ আশঙ্কার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দেননি। এদিকে সামা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আসিফ বলেন, আমাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে, কারণ যুদ্ধ দিগন্তে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। তিনি আরও বলেন, আগামী এক-দুই-তিন বা চার দিনের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার স্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীরের ফের সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কায় ৪৮টি পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ : পেহেলগামে ফের সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা রয়েছে- গোয়েন্দাদের কাছ থেকে এ ধরনের একটি সতর্কবার্তা পাওয়ার পরেই কাশ্মীরের ৮৭টি পর্যটন কেন্দ্রের মধ্যে ৪৮টি বন্ধ করে দিয়েছে জম্মু ও কাশ্মীর সরকার। জানা গেছে যে, সন্ত্রাসী সংগঠনগুলো আগামী দিনগুলোতে নিরাপত্তা বাহিনী এবং অস্থানীয় ব্যক্তিদের লক্ষ্য করে সক্রিয় হামলার পরিকল্পনা করছে। এ তথ্য আসার পরেই তাদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ (আইএসআই) বিভিন্ন জায়গায় বিশেষ করে শ্রীনগর এবং গান্ডারবাল জেলায় অস্থানীয় ব্যক্তি, সিআইডি সদস্য এবং কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে। এর মধ্যে পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে উপত্যকায় সক্রিয় সন্ত্রাসীদের বাড়িঘর ধ্বংসের প্রতিশোধ নিতে উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ কাশ্মীরজুড়ে আরও জোরদার এবং বৃহত্তর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরিকল্পনা করছে সন্ত্রাসীরা। প্রতিবেদনে আরও সতর্ক করা হয়েছে যে, রেলওয়ে অবকাঠামোর দুর্বলতা এবং উপত্যকায় অস্থানীয় রেলকর্মীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতির কারণে রেলওয়েকে লক্ষ্য করে আক্রমণের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। নিরাপত্তা এজেন্সিগুলোর তরফে রেলওয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের তাদের নির্ধারিত ক্যাম্প এবং ব্যারাকের বাইরে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে। গোয়েন্দাদের কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়ার পরেই নিরাপত্তা বাহিনী গুলমার্গ, সোনামার্গ এবং ডাল লেক এলাকাসহ সংবেদনশীল পর্যটন স্থানগুলোতে প্রাথমিকভাবে জম্মু ও কাশ্মীর পুলিশের স্পেশাল অপারেশন গ্রুপ থেকে ফিদায়িন-বিরোধী স্কোয়াড মোতায়েন করেছে। সামগ্রিকভাবে কাশ্মীরে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। এদিকে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক পদক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, হামলার পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি একডজনেরও বেশি দেশের নেতার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন।
পাশাপাশি নয়াদিল্লিতে অবস্থিত ১০০টিরও বেশি কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিদের ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে নেওয়া হয়েছে। তবে এসব প্রচেষ্টা উত্তেজনা হ্রাসের জন্য নয় বরং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন একাধিক কূটনীতিক। এর আগে এক ভাষণে মোদি সন্ত্রাসী আস্তানাগুলো ধ্বংস এবং কঠোর শাস্তি দেওয়ার ঘোষণা দেন। যদিও সরাসরি পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করেননি।
ড্রোন ভূপাতিতের দাবি করেছে পাক সেনাবাহিনী : আকাশসীমা লঙ্ঘনের কারণে ভারতের একটি কোয়াডকপ্টার (ড্রোন) ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। গতকাল পাক সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) বরাবর ভারতের ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করেছে। সূত্র জানিয়েছে, ভিম্বার জেলার মানাওয়ার সেক্টরে শত্রুপক্ষ কোয়াডকপ্টার দিয়ে নজরদারি চালানোর চেষ্টা করছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সময়মতো পদক্ষেপ নিয়েছে এবং শত্রুর বিদ্বেষপূর্ণ চেষ্টা প্রতিহত করেছে। সূত্র আরও জানিয়েছে, যে কোনো আগ্রাসন দ্রুত এবং কার্যকরভাবে রুখে দিতে সেনাবাহিনী পুরোপুরি প্রস্তুত আছে। অবশ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করেনি ভারত। ভারতের প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক অজয় শুক্লা বলেন, সিমলা চুক্তি থেকে কোনো একপক্ষ বা উভয়পক্ষ বেরিয়ে গেলে, তার অর্থ হবে নিয়ন্ত্রণরেখা নিয়ে (ভারত-পাকিস্তান) ‘কেউ কিছু মানতে বাধ্য থাকবে না’। এই বিশ্লেষক গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এটি (সিমলা চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া) নিয়ন্ত্রণরেখায় দুই দেশের অবস্থানগত পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। বর্তমানে চুক্তির অধীন সেখানে শান্তি বজায় রয়েছে। কিন্তু যখন কোনো চুক্তি থাকবে না, তখন দুই দেশ অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহারে উৎসাহিত হতে পারে।’