দেশে ঋণের উচ্চ সুদের চাপ এড়াতে বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছেন দেশের ব্যবসায়ীরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল—এই তিন মাসে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে ৪৫৪ মিলিয়ন ডলার। বিশ্লেষকদের মতে, বর্তমানে দেশে ব্যাংকঋণের গড় সুদের হার ১৬ শতাংশ ছাড়িয়েছে, যেখানে বিদেশি ঋণের হার ৮ শতাংশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এতে সুদের ব্যবধান দ্বিগুণের কাছাকাছি হওয়ায় উদ্যোক্তারা টাকাভিত্তিক ঋণের বদলে ডলারভিত্তিক ঋণ নেওয়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি ২০২৫ শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৯.৮ বিলিয়ন ডলার, যা ছিল গত চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। কিন্তু ফেব্রুয়ারি থেকে ঋণ গ্রহণের গতি বাড়তে শুরু করে এবং এপ্রিল শেষে ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ১০.২৫ বিলিয়ন ডলারে, যা তিন মাসে ৪.৫৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করে।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন বলেন, ‘ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ার কারণেই বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। কারণ বিদেশ থেকে ঋণ নিলে ৮ শতাংশের মধ্যে ঋণ পাওয়া যায়। আর দেশের বাজারে এই সুদ ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। যেহেতু সব ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে ঋণ আনতে পারবেন না, তাই দেশের ব্যাংকঋণের সুদহার যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনা দরকার। তা না হলে চলমান শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ব্যবসায়ীরা কিস্তি দিতে পারবেন না। নতুন করে খেলাপি হবেন।’
বিশ্লেষকরা বলছেন, বর্তমানে রিজার্ভ তুলনামূলক স্থিতিশীল এবং ডলারের বিনিময় হারও আগের মতো অস্থির নয়। ফলে বিদেশি ঋণ গ্রহণের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কমে এসেছে।
এদিকে দেশে উচ্চ নীতি সুদের (১০ শতাংশ) প্রভাবে ব্যাংকগুলো ঋণের সুদহার বাড়িয়ে দিয়েছে, যার ফলে বেসরকারি বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এপ্রিল ২০২৫ শেষে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে মাত্র ৭.৫০ শতাংশে, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে অন্যতম নিচু অবস্থান।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, টেকসই বিনিয়োগ এবং উৎপাদনশীল খাতে অর্থায়ন নিশ্চিত করতে হলে সুদের ভারসাম্য রক্ষা, মুদ্রানীতি বাস্তবমুখী করা এবং বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় সতর্কতা অবলম্বন জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, এখন বিদেশি ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৮ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কারণ সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং বা এসওএফআর রেট প্লাস আড়াই থেকে ৩ শতাংশ প্রিমিয়াম দিতে হয়। আর ১৯ জুনের তথ্য মতে, এখন এসওএফআর রেট ৪.৩২ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে টাকায় ঋণের সুদহার ১৬ শতাংশের ওপরে। ফলে ডলারে ঋণ গ্রহণে প্রায় দ্বিগুণ লাভ।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘কাঁচামালের আমদানি দায় পরিশোধে ইউপিএএস এলসি (ইউসেন্স পেয়েবল অ্যাট সাইট লেটার অব ক্রেডিট) খোলা এবং বায়ার্স ক্রেডিট নেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। তা ছাড়া আমাদের চলতি হিসাবের ভারসাম্য উন্নত হয়েছে। বিনিময় হার কিছুটা হলেও স্থিতিশীল। মূল্যস্ফীতি এক অঙ্কে নেমে আসা এবং টাকার তুলনায় ডলারে ঋণের সুদ কম থাকায় অনেকেই বিদেশি ঋণের দিকে ঝুঁকছেন। সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনৈতিক সূচকগুলো আগের তুলনায় উন্নতির দিকে যাচ্ছে। পাশাপাশি অর্থনৈতিক তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে বিদেশে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা বা বিশ্বাসযোগ্যতাও বেড়েছে, যার ফলে এখন বিদেশি ব্যাংকগুলো আমাদের গ্রাহকদের ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে।’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, এ বছরের জানুয়ারির আগ পর্যন্ত স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ সর্বনিম্ন ছিল কেবল ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ৯.২ বিলিয়ন ডলার। এরপর এই ঋণের পরিমাণ ক্রমাগত বেড়ে ২০২১ সালের শেষে দাঁড়ায় ১৫.৪৬ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ এক বছরের মধ্যেই বেড়েছে প্রায় ছয় বিলিয়ন ডলার।
২০২২ সালের ডিসেম্বর নাগাদ বেসরকারি খাতের স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি দাঁড়ায় ১৬.৪২ বিলিয়ন ডলারে। তবে এর পর থেকে ঋণের পরিমাণে মাসিক হারে হ্রাস লক্ষ করা যায়। ঋণের স্থিতি প্রায় ২.৩ বিলিয়ন ডলার কমে যায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ প্রান্তিকে। ২০২৪ সালের এপ্রিলের তুলনায় চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই ঋণের পরিমাণ প্রায় ৮৯০ মিলিয়ন ডলার হ্রাস পেয়েছে।
২০২৩ সালে ডলারের বিনিময় হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা হঠাৎ বিদেশি ঋণ পরিশোধ শুরু করে দেন। কারণ তাঁরা বিনিময় হারের ঝুঁকি নিতে চাননি। এ সময় বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে ১৬.৪২ বিলিয়ন থেকে ১১.৭৯ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে। তবে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আবার স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ফেব্রুয়ারি শেষে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে দাঁড়ায় ১০.১৬ বিলিয়ন ডলারে।
গত ২১ মে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সভাপতিত্বে এক সভায় স্ক্রটিনি কমিটি অন ফরেন লোন অ্যান্ড সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট কমিটি (বৈদেশিক ঋণ ও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট যাচাই কমিটি) মোট ২০ মিলিয়ন ডলারের বেশি নতুন ঋণ প্রস্তাব অনুমোদন দিয়েছে। কমিটি ৯৮৮ মিলিয়ন ডলারের ঋণ পুনর্গঠন ও ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেয় আরো ৩১৫ মিলিয়ন ডলার ঋণে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রহমান বলেন, ‘এই সরকার কত দিন থাকে সেটা নিয়ে এত দিন বিনিয়োগকারীরা হতাশার মধ্যে ছিলেন। যেহেতু নির্বাচনের একটি তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে, তাই ব্যবসায়ীদের আত্মবিশ্বাস বাড়তে শুরু করেছে। তার মানে এই না যে নতুন বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে বাড়ছে। তথ্য মতে, যে পরিমাণ বেড়েছে তা খুবই নগণ্য। কারণ দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো শতভাগ স্থিতিশীল নয়। কিছুটা ভালো হয়েছে, তবে পুরোপুরি না। সার্বিক পরিস্থিতির উন্নতি খুবই শ্লথ।’
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন আরো বলেন, ‘দেশে এখনো বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি হয়নি। কারণ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখনো পুরোপুরি শান্ত নয়। নতুন সরকার এলে তাদের নিয়ম-নীতির ওপর নির্ভর করবে নতুন বিনিয়োগ। তা ছাড়া গ্যাসসংকটের কোনো সমাধান হয়নি এখনো। তাই বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ বাড়লেও নতুন করে বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা খুবই কম।’
স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বায়ার্স ক্রেডিট। জানুয়ারিতে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৫.০৮ বিলিয়ন ডলার, যা এপ্রিল শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫.৫৩ বিলিয়নে। তিন মাসে প্রায় ৪৪৩ মিলিয়ন ডলার বেড়েছে। এ ধরনের ঋণে বাংলাদেশি রপ্তানিকারকরা বিদেশি ক্রেতার কাছ থেকে আগাম রপ্তানি আদেশের ভিত্তিতে অর্থ গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০২৫ সালের এপ্রিল শেষে ডেফারড পেমেন্ট আউটস্ট্যান্ডিং দাঁড়িয়েছে ৬২২ মিলিয়ন ডলার, যা জানুয়ারির শেষে ছিল ৬৪৪ মিলিয়ন ডলার।
জানা যায়, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বারবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। সর্বশেষ তা দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে, যা দেশের ইতিহাসে অন্যতম উচ্চহার। এতে উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে বিনিয়োগে দেখা দিয়েছে স্থবিরতা। কারণ ব্যাংকঋণ নিতে গেলে সুদ গুনতে হচ্ছে ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর মুদ্রানীতি ঘোষণার দিন সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মূল্যস্ফীতি না কমা পর্যন্ত নীতি সুদহার ১০ শতাংশে রাখা হবে। মূল্যস্ফীতি কমলে নীতি সুদহার কমানো হবে। গভর্নর বলেছেন, ‘ব্যবসায়ীরা চাপ দিলেই যে সুদহার কমিয়ে দেব, তা হবে না। আগে মূল্যস্ফীতি কমবে, তারপর পলিসি রেট ধীরে ধীরে কমানো হবে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭.৫০ শতাংশ, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২.৪০ শতাংশ কম। চলতি বছরের এপ্রিল মাসে ব্যাংকগুলোর বেসরকারি ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮২২ কোটি, যা মার্চ মাসে ছিল ১৭ লাখ ১৯ হাজার ৫১২ কোটি টাকা।
মার্চে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৭.৫৭ শতাংশ, যা জুলাই-আগস্টের পটপরিবর্তনের পর টানা আট মাস ধরে নিম্নমুখী প্রবণতায় ছেদ টেনেছিল। আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬.৮২ শতাংশ। তার আগের মাস জানুয়ারিতে এই খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭.১৫ শতাংশ। সৌজন্যে : কালের কণ্ঠ