জাপানের ক্রাউন প্রিন্স আকিশিনো ও প্রিন্সেস কিকোর একমাত্র পুত্র সন্তান যুবরাজ হিসাহিতো। সদ্যই পা দিয়েছেন উনিশ বছর বয়সে। আর এ উপলক্ষে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে জাপানের রাজপরিবারে।
কারণ গত ৪০ বছরে প্রথমবারের মতো প্রাপ্তবয়স্ক যুবরাজ পেল জাপানের রাজপরিবার। তিনিই হতে যাচ্ছেন জাপানের পরবর্তী সম্রাট। সম্ভবত, তিনিই হবেন দেশটির রাজতন্ত্রের শেষ সম্রাটও।
শনিবার হিসাহিতোকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যে রাজকীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলো করা হয়েছে, তা বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো রাজতন্ত্রের জন্য এক অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা মনে করিয়ে দেয়। এর কারণ মূলত পুরুষ-শাসিত উত্তরাধিকার নীতি এবং রাজপরিবারের সদস্য সংখ্যা কমে যাওয়া।
হিসাহিতো হলেন ক্রাইস্যান্থেমাম সিংহাসনের দ্বিতীয় উত্তরাধিকারী। সম্ভবত একদিন তিনি সম্রাট হবেন। কিন্তু তার পরে আর কেউ নেই যিনি এই সিংহাসনে বসবেন। বিষয়টি জাপানের রাজপরিবারকে এক উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। কারণ বর্তমানে জাপানের সম্রাট নিরুহিতো। তার কোনো পুত্র সন্তান নেই।
‘ড্রাগনফ্লাই প্রিন্স’
সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টোকিওর কাছে সুকুবা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন ভর্তি হয়েছে হিসাহিতো। জীববিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করছেন তিনি। পোকামাকড়, বিশেষ করে ফড়িংয়ের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। তিনি টোকিওর আকাসাকা এস্টেটের এলাকায় ফড়িং নিয়ে একটি গবেষণাপত্রও লিখেছেন। এই যুবরাজ ব্যাডমিন্টন খেলতে বেশ ভালোবাসেন।
মার্চ মাসে তার প্রথম সংবাদ সম্মেলনে যুবরাজ জানান, শহুরে এলাকায় পোকামাকড়ের সংখ্যা সংরক্ষণের উপায় খুঁজে বের করাই তার আগ্রহের অন্যতম ক্ষেত্র। এ কারণেই হিসাহাতো পরিচিত ‘ড্রাগনফ্লাই প্রিন্স’ হিসেবে।
২০০৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন হিসাহিতো। তিনি যুবরাজ আকিশিনো তার স্ত্রী যুবরাজী কিকোর একমাত্র পুত্র।
হয়তো তিনিই হবেন শেষ সম্রাট
হিসাহিতো বর্তমান সম্রাট নারুহিতোর ভাতিজা। সম্রাট একজন কন্যা আছেন, নাম প্রিন্সেস আইকো। হিসাহিতোর বাবা আকিশিনো ১৯৮৫ সালে শেষবারের মতো প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পুরুষ রাজপরিবারের সদস্য ছিলেন।
রাজপরিবারে এখন ১৬ জন সদস্য আছেন, যারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক। হিসাহিতো ও তার বাবা বাদে আর কোনো পুরুষ উত্তরসূরি নেই। আরেকজন রয়েছেন প্রিন্স হিতাচি। কিন্তু বর্তমানে তার বয়স ৮৯ বছর।
পুরুষ উত্তরসূরির সংকট জাপানের রাজতন্ত্রের জন্য বড় চিন্তার বিষয়। ইতিহাস অনুযায়ী, রাজতন্ত্র প্রায় ১,৫০০ বছর ধরে টিকে আছে। তবে দেশের জনসংখ্যা কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ছে।
একসময় নারীরাও জাপানের সিংহাসনে বসতে পারতেন। ইতিহাসে আটজন নারী জাপানের সম্রাট হয়েছেন। যদিও কেউই রাজপরিবারের উত্তরসূরি জন্ম দেননি।
১৮৮৯ সালের সংবিধানে প্রথমবার পুরুষদের জন্যই সিংহাসন নির্ধারণ করা হয়। এরপর ১৯৪৭ সালের রাজপরিবার সংক্রান্ত আইনেও একই নিয়ম রাখা হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধুমাত্র পুরুষ উত্তরাধিকার নিয়মটি অনেক পুরনো এবং বর্তমানে এটি কার্যকর রাখা প্রায় অসম্ভব। আগে কনকুবাইন (সম্রাটের গৃহিণী বা উপপত্নী) থাকায় সন্তান জন্ম হত, কিন্তু এখন তা নেই।
সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞী মাসাকোর একমাত্র সন্তান প্রিন্সেস আইকো। জাপানের জনগণের কাছে তিনি বেশ জনপ্রিয়। অথচ রাজপরিবারের নিয়ম অনুযায়ী তিনি সম্রাট হতে পারবেন না।
রাজমুকুট, ঘোড়ার গাড়ি আর প্রার্থনা
শনিবার হিসাহিতোর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার অনুষ্ঠান শুরু হয় তার বাসভবন থেকে। তিনি টাক্সিডো পরে সম্রাট নারুহিতোর কাছ থেকে রাজমুকুট গ্রহণ করেন। এরপর রাজপ্রাসাদে মূল অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠানে একটি ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে আসেন হিসাহিতো। পরে তার মাথার কাপড় সরিয়ে রাজমুকুট পরানো হয়। তিনি যে প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছেন, ওই মুকুট পরিয়ে সেটিই বোঝানো হয়।
জাপানের সিংহাসনে নারীদের বসাতে সমস্যাটা কোথায়?
২০২২ সালে একটি রক্ষণশীল বিশেষজ্ঞ প্যানেল সুপারিশ করে যে, রাজপরিবারের হাল ধরার ক্ষেত্রে পুরুষ সদস্যদের অগ্রাধিকারে ধারা বজায় রাখা হোক। তারা নারীদের বিষয়ে প্রস্তাব দেয় যে, তারা বিয়ের পরও রাজকীয় মর্যাদা ও আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন।
কিন্তু রাজকন্যাদের জামাই ও তাদের সন্তানদের রাজকীয় মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে নতুন করে বিতর্ক ওঠে। এই বিতর্ক আপাতত এখানেই থমকে আছে।
এর ফলে, হিসাহিতোর কাঁধে পুরো রাজপরিবারের ভবিষ্যৎ দায়িত্ব এসে পড়েছে বলে জানান প্রাক্তন রাজপ্রাসাদ দফতরের প্রধান শিংগো হাকেতা। তার মতে, রাজতন্ত্রকে কীভাবে বাঁচিয়ে রাখা যায় সেই পরিকল্পনাই এখন করা উচিত। নারী কিংবা পুরুষ যেই হোক জাপানের রাজতন্ত্র বাঁচিয়ে রাখতে এখন উত্তরসূচির লিঙ্গ নিয়ে ভাবার সময় নেই বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
তবে আপাতত রাজপরিবার এখন ব্যস্ত হিসাহাতোর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার অনুষ্ঠান ঘিরে।
সূত্র : সিএনএন
বিডি প্রতিদিন/কেএ