২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আসামিদের খালাস দিয়ে হাই কোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল খারিজ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ এ রায় দেন। হাই কোর্টের রায়ের কিছু অংশ সংশোধন ও প্রত্যাহার সাপেক্ষে পর্যবেক্ষণসহ এ রায় দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের ওপর গত ২১ আগস্ট পঞ্চম দিনে শুনানি শেষ হয়। আদালত রায়ের জন্য ৪ সেপ্টেম্বর তারিখ ধার্য করেছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল সর্বসম্মতিতে রায় দেন আপিল বিভাগ। সকাল ১০টা ৫ মিনিটে এজলাসে আসেন বিচারপতিরা। আসন গ্রহণের পর প্রধান বিচারপতি রায় ঘোষণা শুরু করেন। সকাল ১০টা ১৮ মিনিটে রায় ঘোষণা শেষ হয়। হাই কোর্টের রায়ের কিছু অংশ প্রত্যাহার ও সংশোধন সাপেক্ষে পর্যবেক্ষণসহ এ রায় দেওয়া হয়। আদালতে আসামিপক্ষে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অনীক আর হক, আবদুল জব্বার ভূঁইয়া, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ মাসুদ।
আদালতে বিএনপির আইনজীবীদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, অ্যাডভোকেট আমিনুল ইসলাম, অ্যাডভোকেট মাকসুদ উল্লাহ, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ ছিদ্দিক উল্লাহ মিয়া প্রমুখ।
রায়ের পর সর্বোচ্চ আদালতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে আইনজীবী এস এম শাহজাহান সাংবাদিকদের বলেন, সর্বোচ্চ আদালত আপিলসহ সব আবেদন খারিজ করেছেন। অর্থাৎ হাই কোর্টের খালাসের রায় বহাল আছে। এ রায়ের মধ্যদিয়ে আপিল বিভাগ ও হাই কোর্ট বিভাগ ন্যায়ের মানদণ্ড আবার উঁচু করে ধরলেন। এই রায়ের মাধ্যমে আবার প্রমাণিত হলো আইনের শাসন আছে। বিনা বিচারে অন্যায়ভাবে কাউকে ফাঁসি বা সাজা দেওয়া যাবে না। এই ধারাবাহিকতা যেন বজায় থাকে।
বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, মামলাটি ছিল একটি জঘন্য অপরাধের মামলা। কিন্তু শেখ হাসিনা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, ব্যক্তিগত জিঘাংসা থেকে তারেক রহমানকে এ মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আজ (গতকাল) সর্বোচ্চ আদালতের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, তারেক রহমান নির্দোষ। তিনি খালাস পেয়েছেন। পাশাপাশি এটাও প্রমাণিত হয়েছে, এ ঘটনায় আইভি রহমানসহ যাদের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু হয়েছে, শেখ হাসিনা সেসব মৃত্যুর বিচার চাননি। যদি শেখ হাসিনা প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চাইতেন, তাহলে হয়তো রাজনৈতিক জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে তারেক রহমানকে এ মামলায় অন্তর্ভুক্ত করতেন না।
এ মামলায় মুফতি হান্নানসহ ১২ জন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছিল। এনিয়ে সর্বোচ্চ আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, যে পরিস্থিতিতে আসামিদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, সেসব জবানবন্দি কতটুকু স্বতঃস্ফূর্ত ছিল তা নিয়ে গুরুতর সন্দেহ আছে। যেমন, কথিত মূল পরিকল্পনাকারী মুফতি আবদুল হান্নান প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার চার বছর পর দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। দ্বিতীয় জবানবন্দির জন্য ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করার আগে তিনি দীর্ঘ সময় কনডেমড সেলে বন্দি ছিলেন। বাকি আসামিরাও দীর্ঘ সময় পুলিশি হেফাজতে থাকার পর ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া, তিনজন আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি একজন ম্যাজিস্ট্রেট এক দিনে অস্বাভাবিক গতিতে রেকর্ড করেন, যা এ-সংক্রান্ত নিয়ম-নীতির গুরুতর লঙ্ঘন। অধিকাংশ আসামি তাদের স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করার জন্য আবেদন করেছিলেন। তাদের যুক্তি ছিল- স্বীকারোক্তি নেওয়ার আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের অমানবিক নির্যাতন-নিপীড়ন করে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের আদেশ ছাড়া অবৈধভাবে হেফাজতে রেখেছিল। ফলে স্বীকারোক্তি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ছিল কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
সর্বোচ্চ আদালত বলেন, সবচেয়ে বড় কথা- কথিত অভিযুক্ত মুফতি আবদুল হান্নানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করায় ১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারা অনুসারে তাকে স্বীকারোক্তির বিষয়ে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়নি, যা মামলাটিকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করেছে। ফলে এসব স্বীকারোক্তি হয় চাপ প্রয়োগ করে, নয় প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আদায় করা হয়েছে, যা আইনের চোখে বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে বিবেচিত হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত বলেন, চূড়ান্ত বিশ্লেষণে এ স্বীকারোক্তিগুলো নির্ভরযোগ্যতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ বিষয়টি হাই কোর্টের রায়ে উপেক্ষা করা হয়েছে, যা পর্যালোচনা করা উচিত ছিল।
মামলাটি নতুন করে তদন্ত করা প্রয়োজন উল্লেখ করে হাই কোর্ট রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন, তা সঠিক নয় উল্লেখ করে বাতিল করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। এ নিয়ে আপিল বিভাগের রায়ে বলা হয়েছে, মামলার নথিভুক্ত তথ্য এবং বিদ্যমান পরিস্থিতির সঙ্গে এই পর্যবেক্ষণ সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাছাড়া কোনো নীতিনির্ধারণী বিষয়ে প্রভাব তৈরি করে এমন কোনো পর্যবেক্ষণ আদালত দিতে পারেন না। ক্ষমতার পৃথকীকরণ নীতির ভিত্তিতে হাই কোর্টের এ পর্যবেক্ষণটি বাতিল করা প্রয়োজন। কারণ এ পর্যবেক্ষণ নীতিনির্ধারণী বিষয়ে বিচারিক হস্তক্ষেপের শামিল।
এ পর্যবেক্ষণ ছাড়া হাই কোর্টের রায়ে কোনো ত্রুটি বা অবৈধ কিছু খুঁজে পাওয়া যায়নি উল্লেখ করে সর্বোচ্চ আদালত রায়ে বলেন, ‘ফলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ বাতিল ও রায়ের কার্যকর অংশে সংশোধনসাপেক্ষে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল খারিজ করা হলো। একই সঙ্গে হাই কোর্টের খালাসের রায় বহাল রাখা হলো। সাজাপ্রাপ্ত (বিচারিক আদালতের রায়ে) যেসব আসামি আপিল করেননি, খালাসের এ রায় তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। এ মামলায় কারও বিরুদ্ধে পরোয়ানা থাকলে তা প্রত্যাহার করা হলো। আর আপিলের অনুমতির জন্য সংযুক্ত সব ফৌজদারি আবেদন নিষ্পত্তি করা হলো। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। এতে ২৪ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক নেতা-কর্মী। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার এই ঘটনায় তখন মামলা হয়েছিল মতিঝিল থানায়। মামলার তদন্ত নিয়ে তখন নানা বিতর্ক উঠেছিল। ২০০৭ সালে এক-এগারোর পট-পরিবর্তনের পর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলার তদন্ত নতুনভাবে শুরু করে সিআইডি। সংস্থাটি ২২ জনকে আসামি করে পরের বছর আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এ-সংক্রান্ত মামলা দুটির (হত্যা ও বিস্ফোরক) অধিকতর তদন্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনকে আসামি করা হয়। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ মামলার রায় দেন। রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। আরও ১১ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। এরপর হাই কোর্টে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন), আপিল, জেল আপিল ও বিবিধ আবেদনের ওপর শুনানি হয়। পরে গত বছরের ১ ডিসেম্বর হাই কোর্ট রায় দেন। এতে বিচারিক আদালতের দেওয়া সাজার রায় বাতিল করা হয়। ফলে মামলা থেকে সবাই খালাস পান। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ করা হয়। এরপর রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে। চলতি বছরের ১ জুন লিভ টু আপিল (বিস্ফোরক মামলায়) মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। এরপর হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এই আপিলের ওপর গত ২১ আগস্ট শুনানি শেষ হয়।