বাংলাদেশে তুলা রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ সুবিধা পেলেও সে তুলায় তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কোনো সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশ বা এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ উন্নত বিশ্ব যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্যভুক্ত, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা পেলেও যুক্তরাষ্ট্রে তা পায়নি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত দেশের বাইরে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র চীন বাংলাদেশকে ২০২১ সাল থেকে প্রথমে ৯৮ ও পরে তা বাড়িয়ে ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কসুবিধা দিচ্ছে। এমনকি সাফটার আওতায় ভারতের বাজারে ২৫টি পণ্য বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা পাচ্ছে বাংলাদেশ। সেখানে উন্নত রাষ্ট্র হয়েও যুক্তরাষ্ট্র কখনোই বাংলাদেশকে শতভাগ শুল্কসুবিধা দেয়নি। তারা বাংলাদেশকে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা দিয়েছে। তবে এ ৯৭ শতাংশের ভিতর বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক রাখেনি। এমনকি রানা প্লাজা ধসের পর ২০১৩ সাল থেকে শ্রম কমপ্লায়েন্সের শর্ত দিয়ে বাংলাদেশকে দেওয়া জিএসপি সুবিধাও প্রত্যাহার করে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সঙ্গে টিকফা করলে জিএসপি সুবিধা ফেরত পাওয়া যেতে পারে, এমন কথা বলা হলেও গত ১২ বছরেও তা পাওয়া যায়নি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলা দিয়ে বাংলাদেশে যে পোশাক তৈরি হয়, অন্তত সে পোশাকে যেন জিএসপি সুবিধা বহাল রাখে, টিকফা ফোরামে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কয়েক বছর ধরে সে অনুরোধ জানানো হচ্ছে। সেটিও রাখেনি যুক্তরাষ্ট্র।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানিতে ফিউমিগেশনের (বন্দরে তুলা ছাড়ের ক্ষেত্রে পোকা মারতে ধূমায়িতকরণ) যে শর্ত ছিল, এটি প্রত্যাহারের জন্য টিকফা ফোরামে বাংলাদেশকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছিল। ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার সরকার শুধু যুক্তরাষ্ট্র থেকে তুলা আমদানিতে ওই ফিউমিগেশন শর্ত প্রত্যাহার করে নেয়। ফলে বাংলাদেশে তুলা রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা পেলেও সে তুলা দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রে সুবিধা পাচ্ছে না বাংলাদেশ। শুধু তাই নয়, স্বল্পোন্নত দেশ হওয়ার পরও যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের চেয়েও বেশি শুল্ক দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্কারোপের আগে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য ঢুকতে হলে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হতো, পাকিস্তানকে দিতে হয় ৩ শতাংশ। অথচ একই পণ্যের জন্য ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে শুল্ক নিচ্ছে সর্বোচ্চ ১ শতাংশ। আর এখন পাল্টা শুল্কারোপের পর বাংলাদেশকে ভারত, পাকিস্তানসহ বিশ্বের অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় বেশি শুল্ক দিয়ে, যা এখনকার ৩৭ এবং আগের ১৫ অর্থাৎ প্রায় ৫২ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।
অর্থাৎ ১০০ টাকার একটি কাপড় রপ্তানি করলে যুক্তরাষ্ট্রকে ৫২ টাকা শুল্ক দিতে হবে। এ কারণে বাংলাদেশে তৈরি ১০০ টাকার একটি কাপড়ের দাম যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পড়বে ১৫২ টাকা। এর সঙ্গে বিক্রেতারা মুনাফা যোগ করে তা আরও বাড়াবেন। পাশাপাশি ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য যেসব দেশে বাংলাদেশের তুলনায় কম শুল্ক তারা আরও কম দামে পোশাক দিতে পারবে। এখানেই বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই যে শুল্কবৈষম্য, এটিই অন্যায্য। এটিই ডব্লিউটিওর নীতির পরিপন্থি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতিই হচ্ছে, যেসব দেশ অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, অনুন্নত, সেগুলোকে কিছু সুবিধা দিয়ে সামনে এগোতে সহায়তা করা। যেন দেশটি শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে আরও গুরুত্ব দিতে পারে। মানবসূচক উন্নয়নে নজর দিতে পারে। এ ছাড়া উন্নত দেশগুলো নারীর উন্নয়নে গুরুত্ব দেয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে যে প্রায় ৫০ লাখ শ্রমিক কাজ করে তার প্রায় ৬২ শতাংশই নারী। যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে তৈরি পোশাক খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলে সবার আগে এ নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানে আঘাত আসবে। তাদের চাকরি যাবে, আয় থাকবে না। তারা নিজঘরে আবারও নিগৃহীত হবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক চিফ ইকোনমিস্ট মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে তা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নীতির পরিপন্থি। এ শুল্ক আরোপের ক্ষেত্রে শুধু দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি বিবেচনা করা হয়েছে, এর বাইরে কোনো নীতি বিবেচনা করা হয়নি। এর ফলে বাংলাদেশের মতো ছোট ও অনুন্নত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে। এখন সরকারের উচিত হবে বাংলাদেশের এ ক্ষতির বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক কমিয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে যত দ্রুত সম্ভব পাল্টা শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিতে হবে।’