বিভিন্ন সংস্কার কমিটির বিশেষজ্ঞ শ্রেণিটিকে মনে হয় নতুন একটা কিছু করার প্রবল ঝোঁক খুব ভালোভাবেই পেয়ে বসেছে। নামের মধ্যে তারা বোধ হয় প্রকাণ্ড সব সমস্যা দেখতে পাচ্ছে, যদিও তার কোনো জুতসই ব্যাখ্যা নেই। দেশের নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব অনেক আগেই করা হয়েছে। একাধিক মন্ত্রণালয়ের নাম বদলের সুপারিশও রয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের নাম পরিবর্তন করে একটা কঠিন নাম রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। পরিবর্তনের ঝোঁক দেখে মনে পড়ছে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বিখ্যাত কবিতাটির কথা। সেই কবিতার কয়েকটি লাইন এই সুযোগে পড়ে নেওয়া যাক;
নতুন কিছু করো,
একটা নতুন কিছু করো।
নাকগুলো সব কাটো,
কানগুলো সব ছাঁটো;
পাগুলো সব উঁচু ক’রে,
মাথা দিয়ে হাঁটো;
হামাগুড়ি দাও, লাফাও,
ডিগবাজি খাও, ওড়ো;
কিম্বা চিৎপাত হয়ে ...
পাগুলো সব ছোঁড়ো।’
নতুন কিছু করার প্রবল এই প্রবাহের মধ্যে স্থানীয় সরকার কমিশন স্থানীয় সংস্থাগুলোর ইলেকশন সিস্টেমের খোলনলচে পাল্টে দেওয়ার সুপারিশ করেছে। নতুন ব্যবস্থায় জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত মেম্বারদের পাশাপাশি অনির্বাচিত পার্টটাইম মেম্বার রাখার প্রস্তাবও করা হয়েছে। সরকারি কর্মচারীরাও অনির্বাচিত পার্টটাইম মেম্বার হতে পারবেন। পার্টটাইম মেম্বার-কাউন্সিলর পদবিটি মাশাআল্লাহ নতুনের চেয়েও নতুন। মেম্বার-কাউন্সিলররা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশনের মেয়র ও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবেন। তার মানে চেয়ারম্যান নির্বাচনে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটের আর কোনো হ্যাপা থাকবে না। তারা নিজের ওয়ার্ডে অর্থাৎ ছোট এলাকায় একজন মেম্বার বা কাউন্সিলর নির্বাচিত করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাবেন। চেয়ারম্যান বা মেয়র কে হবেন, তা নিয়ে জনগণের কোনো মাথাব্যথা থাকবে না। এ নিয়ে চিন্তাফিকির যা করার তা করবেন মেম্বার ও কাউন্সিলররা। এই পদ্ধতির ইলেকশন করা হলে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যয় নাকি কমে আসবে। সময়ও কম লাগবে। এই মত প্রকাশ করেছেন কমিশনের প্রধান প্রফেসর তোফায়েল আহমদ। তিনি স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
এরূপ নির্বাচন করার পেছনে আরও একটি যুক্তি দেখিয়েছেন এই বিশেষজ্ঞ। সংসদীয় ব্যবস্থায় দেশের প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন না। সংসদ সদস্যরা তাকে নির্বাচন করেন। কাজেই সেই ধাঁচে চেয়ারম্যান, মেয়ররাও নির্বাচিত হবেন। তবে তিনি নিশ্চয়ই জানেন যে ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে দলীয় সংসদ সদস্যরা প্রধানমন্ত্রী নয়, সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচন করেন। রাষ্ট্রপতি তাঁর কাছে যে দল মেজরিটি বলে প্রতীয়মান হয় সেই দলের নেতাকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার জন্য আহ্বান করেন। প্রধানমন্ত্রীই গোটা সংসদের নেতা। লিডার অব দ্য হাউস। ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি করপোরেশন কোনো পার্লামেন্ট নয়। মেম্বার-কাউন্সিলররাও সংসদ সদস্য নন। ইউনিয়ন পরিষদ বা সিটি করপোরেশনে বিরোধী দল ও বিরোধীদলীয় নেতাও নেই। এখানে কোনো স্পিকারও নেই। এখানে কোনো আইনও তৈরি হয় না। কাজেই চেয়ারম্যান বা মেয়র দেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তুলনীয় হতে পারেন না। সে যা হোক, স্থানীয় সরকারের প্রস্তাবিত নির্বাচন ব্যবস্থাটি এই সময়ের নবীন প্রজন্মের কাছে নতুন হলেও, আসলে তা নয়। বরং একে বলা যায়, নতুন মোড়কে ডেট এক্সপায়ার পুরোনো প্রোডাক্ট। এটি পাকিস্তানের সামরিক একনায়ক ফিল্ড মার্শাল আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের নতুন সংস্করণ। আইউব খান রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর ১৯৬২ সালে এককভাবে যে শাসনতন্ত্র জারি করেন, সেখানে তিনি এই মৌলিক গণতন্ত্রের তত্ত্ব হাজির করেন। মৌলিক গণতন্ত্রে ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বাররাই ছিলেন বেসিক ভোটার। তারাই কেবল জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হতেন। পরে এই মেম্বাররা ইউপি চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পর্যন্ত ভোট দিতেন। ছোট একটা ওয়ার্ডে একজন মেম্বার নির্বাচিত করে দেওয়ার পর আর কোনো ইলেকশনে জনগণের কোনো অংশগ্রহণ ছিল না। এভাবে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল জনসাধারণের ভোটের অধিকার। আইউব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মাহাত্ম্য প্রচার করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করা হয়েছিল। এ খাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় করা হয়েছিল কোটি কোটি টাকা। কিন্তু তাতে শেষ রক্ষা হয়নি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের কফিনে মৌলিক গণতন্ত্রই ছিল সবচেয়ে ধারালো পেরেক।
১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে আইউব খানের পতন হলে মৌলিক গণতন্ত্রের কবর রচিত হয়। আজ ৫৬ বছর পর সীমিত পরিসরে হলেও মৌলিক গণতন্ত্রকে কবর থেকে তুলে আনার চেষ্টা বা সুপারিশ সমর্থনযোগ্য নয়। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় মৌলিক গণতন্ত্রের বীজ বপন করা হলে আখেরে সেটা বিষবৃক্ষের রূপ পরিগ্রহ করতে পারে।
বস্তুত গণতন্ত্র হওয়া উচিত ডিপরুটেড ও ছাতার মতো প্রসারিত। তৃতীয় বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও গণতন্ত্রের সমস্যা পদে পদে। এখানে গণতন্ত্র কখনোই উর্বর জমিন পায়নি। নিরবচ্ছিন্নভাবে গণতন্ত্রের পতাকা বহন করার শক্তি আমাদের হয়নি। এ দেশের মানুষ লড়াই-সংগ্রাম করে বারবার গণতন্ত্রের ঝান্ডা উড়িয়েছেন। আর বারবারই সেই পতাকা হয়েছে ধূলিধূসরিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের রক্তস্নাত বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষ গণতন্ত্রের পতাকা ওড়ালেন। পঁচাত্তরে এসে সেই পতাকা ভূলুণ্ঠিত হলো। তারপর নানান চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে যাও গণতন্ত্র এলো তা-ও হরণ করা হলো ১৯৮২ সালে।
নব্বইয়ের গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা আবার গণতন্ত্র পেলাম। কিন্তু সেই গণতন্ত্র তার সব সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হলো না। গণতন্ত্র যে কী গভীর সুন্দর, কতটা কল্যাণপ্রসূ সেই সত্য বোঝার সুযোগই পেলাম না আমরা। ২০০৭ সালে সেই গণতন্ত্র আবারও অপহৃত হলো।
২০০৮ সালে ইলেকশনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার পেলাম। সেটাও হরণ করে নিল নির্দয় কর্তৃত্ববাদ। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার বাক্স্বাধীনতার কপাট অনেকখানিই খুলে দিয়েছে, যদিও দেশে যথার্থ গণতন্ত্র নেই। বাক্স্বাধীনতা সরকার দিলেও সমাজ দেয়নি। সামান্যতেই ফুঁসে ওঠার প্রবণতা গণতন্ত্রের পথে বড় এক কাঁটা।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে যথেষ্ট গণতান্ত্রিক নয়। দলের ভিতরে গণতন্ত্র নেই। দলের ভিতরে যাদের গণতন্ত্র নেই তারা দেশ-সমাজে গণতন্ত্র পালন করবে কেমন করে? পতিত আওয়ামী লীগ কোনো গণতান্ত্রিক দল নয়। পারিবারিক উত্তরাধিকার এই দলের প্রধান শক্তি। বিএনপিও পারিবারিক উত্তরাধিকার ছাড়া অচল। আরও অনেক ছোট দল রয়েছে যেগুলোর নেতৃত্ব এসেছে উত্তরাধিকার সূত্রে। কোনো কোনো দলে বিভিন্ন পদে কর্মী বাছাই করে নিয়োগ দেওয়া হয়। সদস্যরা কাউকে কোনো পদে নির্বাচিত করেন না। পক্ষান্তরে যে দলগুলোর ভিতর গণতন্ত্র রয়েছে, সেগুলো এখনো যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারেনি। ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত সরকার খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে পরিবারতন্ত্রের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল। সেটা গণতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা প্রাণিত ছিল না।
আইন করে, জবরদস্তি করে বা কৌশল করে রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন আনা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোকেই উদ্যোগী হতে হবে, যাতে দলের ভিতরে গণতান্ত্রিক চর্চার পথ সুগম হতে পারে।
তবে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে একটি শক্তিশালী ও ভারসাম্যপূর্ণ পার্লামেন্ট জরুরি। ওয়েস্টমিনস্টার গণতন্ত্রে পার্লামেন্ট সার্বভৌম। পার্লামেন্ট থেকেই সরকার হয়। আবার এই পার্লামেন্টই হতে পারে সরকারের সবচেয়ে বড় কার্যকর পাহারাদার। কাজেই সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে একটি প্রাণবন্ত সংসদ গঠনে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া উচিত আমাদের। এনসিপির একজন নেতা বলেছেন, কন্টাক্ট পয়েন্ট হবে জনগণ। এটা একটা কাজের কথা। কিন্তু জনগণের সঙ্গে কন্টাক্টের জন্য নির্বাচন ছাড়া আর কোনো কার্যকর পথ নেই। সেই নির্বাচন নিয়ে নানা রকম ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। নতুন নতুন ইস্যু সামনে আনা হচ্ছে। এখন শুনছি সাংবিধানিক কাউন্সিল নিয়ে বিতর্ক। এই বিতর্কগুলো জিইয়ে রাখলে ইলেকশন বিলম্বিত হবে। বিলম্বিত করার উপলক্ষ্য তৈরি হবে।
ইলেকশন খুব বেশি পিছিয়ে গেলে সামনে নতুন নতুন সমস্যা আসবে, তর্কের জায়গা তৈরি হবে। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহু দূর। এতে ইলেকশন অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশঙ্কা। কাজেই সাধু সাবধান। গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি দেশে আছে। সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছেন, তার মধ্যে যাতে ভোটটা হতে পারে, সেটা মাথায় রেখেই রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। তবে মার্চ মাসের পরে আবহাওয়াগত কারণে নির্বাচন অনুষ্ঠান ঝুঁকিপূর্ণ হবে। এটাও মাথায় রাখা বাঞ্ছনীয়। শেষ কথা হলো, ‘সকল কাঁটা ধন্য করে’ জিতে যাক নিখাদ গণতন্ত্র-এমনটাই প্রত্যাশিত।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক