ঢাকার পাঁচতারা হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ক্রিসেন্ট বলরুম লোকে লোকারণ্য। কয়েকজন বাফুফে কর্মকর্তা বাদ দিলে সবাই সংবাদকর্মী। অনেকেই আসন না পেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ক্যামেরা পারসনদের শোরগোল; ‘সামনে থেকে সরে দাঁড়াও’। মঞ্চটা ক্যামেরাবন্দি করতে তৎপর তারা। রিপোর্টারের অনেকে খাতা-কলম নিয়ে প্রস্তুত। কেউ বা মোবাইলে রেকর্ডার অন করে রাখলেন। হামজা দেওয়ান চৌধুরীর প্রথম সংবাদ সম্মেলন হলো ভিড়ের মধ্যেই। এমন ভিড় আরও একবার দেখা গিয়েছিল। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে লিওনেল মেসির সংবাদ সম্মেলনে। মেসির পর হামজা। বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া মেসির সঙ্গেই তুলনা করলেন হামজাকে।
ইংরেজিতেই চলছিল সংবাদ সম্মেলন। হঠাৎ করেই শোনা গেল সিলেটী টানের বাংলা ভাষা। খুব বেশি না হলেও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ফুটবলার হামজা সিলেটী টানের বাংলা ভালোই বলতে পারেন। তিনি জানালেন, বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সি গায়ে জড়ানোর অপেক্ষায় থাকা ফুটবলারকে এরই মধ্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন তার লিস্টার সিটি ও শেফিল্ড ইউনাইটেডের সতীর্থরা। জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলতে অপেক্ষার প্রহর গুনছেন হামজা।
লিস্টার সিটি আর শেফিল্ড ইউনাইটেডে দুরন্ত ফুটবল খেলে ফুটবল বিশেষজ্ঞদের প্রশংসা কুড়িয়েছেন হামজা। এবার তিনি বাংলাদেশের লাল-সবুজ জার্সিতে খেলে কী করতে চান? সোজাসাপ্টা উত্তরই দিলেন তিনি। ‘এই দলের টেকনিক্যাল স্কিল বেশ ভালো। আমি ভিডিও দেখেছি। কোচের সঙ্গেও কথা হয়েছে। আমি নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েই এ দলকে সাহায্য করার চেষ্টা করব।’ ভারতের বিপক্ষে কী করতে চান? এবারও কোনো রাখ-ঢাক করলেন না হামজা। বললেন, ‘আমরা জয় পেতে চাই।’ জয়ের গল্প শোনালেন কোচ হাভিয়ের কাবরেরা এবং অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়াও। ভারতীয় দলটাকে নিয়ে কী ভাবছেন হামজা? বললেন, ‘আমি ওদের ব্যাপারে ভালোই জানি।’ আর জামাল ভূঁইয়া বললেন, ‘সুনীল ছেত্রী অনেক গোল করেছেন ভারতের হয়ে। অনেক ভালো মানের ফুটবলার তিনি। তবে আমি এটা বলতে চাই, হামজা কিন্তু ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ফুটবলার।’ পরোক্ষ ভারতকে একটা হুমকিই দিয়ে রাখলেন জামাল। সুনীল ছেত্রী গত বছর অবসর নেন। তবে কিছুদিন আগে ফের তাকে জাতীয় দলে ডাকা হয়। ভারতও হামজার জন্য প্রস্তুতিতে কোনোরকম ত্রুটি করছে না।
হামজা চৌধুরী লিস্টার সিটিতে নাম লেখান ছেলেবেলায়। সেসময় এই ক্লাবের নাম বাংলাদেশের মানুষ কমই জানত। ২০১৫-১৬ মৌসুমেই লিস্টার সিটি বড় ক্লাব হয়ে ওঠে। সেই মৌসুমে তারা ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ জয় করে। এরপর এফএ কাপ এবং কমিউনিটি শিল্ডও জয় করে। আন্ডারডগ থেকে বড় ক্লাব হয়ে ওঠে লিস্টার সিটি। বাংলাদেশও ফুটবলে আন্ডারডগ টিম। হামজা কী দুটো দলের মধ্যে কোনো মিল খুঁজে পান। তিনি বললেন, ‘আমার কাছে একইরকম মনে হয়। এখানেও আমাদের আন্ডারডগ থেকে ভালো করার সম্ভাবনা আছে।’ সেই সম্ভাবনাই সত্যি করে দেখাতে এসেছেন হামজা চৌধুরী! তার আগমনে লাল-সবুজের দল মানসিকভাবে অনেকটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। শেষবার ভারতে গিয়ে ফুটবল লড়াইয়ে নেমে ড্র করেছিল বাংলাদেশ (২০১৯ সালে)। এরপর ভারতে গিয়ে খেললেও তাদের প্রতিপক্ষ হয়নি বাংলাদেশ। প্রায় ছয় বছর পর ভারতের মাটিতে সুনীল ছেত্রীদের পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ দিতে প্রস্তুতি কাবরেরার শিষ্যরা। মাঠের লড়াইটা ঠিকঠাক হলেই হয়। আজ সকালে ঢাকা ছাড়বে বাংলাদেশ দল। কলকাতা হয়ে পৌঁছাবে শিলং।
হামজার আগমনে রোমাঞ্চিত বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীরা। রোমাঞ্চিত হামজা নিজেও। জামাল ভূঁইয়া ইউরোপিয়ান ফুটবল খেলে বাংলাদেশে এসে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়ান ২০১৩ সালে। নিজের প্রথম ম্যাচের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে জামাল বলেন, জাতীয় সংগীত বাজতেই সেই ম্যাচে আমার লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত, হামজার ক্ষেত্রেও তাই হবে। লাল-সবুজের জার্সি গায়ে মাঠে নামার পর জাতীয় সংগীত বাজলে তারও লোম দাঁড়িয়ে যাবে। জামালের বক্তব্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে হামজার মুখ। তার হাসিতে রং ছড়িয়ে পড়ে। ২৫ মার্চ ভারত ম্যাচের পর এমন হাসি ছড়িয়ে পড়বে কি ফুটবলপ্রেমীদের মুখে মুখে!