ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের শুরুটা ছিল ভিন্ন। তিনি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে একটি নতুন সম্পর্ক গড়ে তোলার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। 'ট্রাম্প ফ্যাক্টর' নামে পরিচিত তার অনিশ্চিত ও চুক্তি করার ক্ষমতাকে অনেক বিশ্লেষক নেতানিয়াহুকে নিয়ন্ত্রণ করার এক নতুন কৌশল হিসেবে দেখেছিলেন। কিন্তু মাত্র ১৫০ দিনের বেশি ক্ষমতায় থাকার পর, সেই 'ট্রাম্প ফ্যাক্টর' যেন নিজেই তার পূর্বসূরিদের মতো এক ফাঁদে পড়েছে। মার্কিন বি-২ বোমারু বিমানগুলো যখন ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানল, তখন মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক যুদ্ধের দামামা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।
নেতানিয়াহুর কূটনৈতিক বিজয়
প্রাথমিক ধারণা ছিল, ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়াহুর সামরিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিয়ন্ত্রণ করবে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। মনে হচ্ছে, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাষ্ট্রকে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রগুলোতে সরাসরি হামলা চালাতে কৌশলে টেনে আনতে পেরেছেন। এর আগেও ওয়াশিংটন নেতানিয়াহুকে একের পর এক সামরিক হামলা থেকে নিবৃত্ত করতে পারেনি। এখন যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি প্রতিশোধমূলক হামলা মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, যা সহজেই একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে।
ট্রাম্প ফ্যাক্টরের পতন
ট্রাম্পের শপথ গ্রহণের কয়েক দিন আগে তাঁর মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক দূত স্টিভ উইটকফ নেতানিয়াহুর সঙ্গে ইসরায়েলে দেখা করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল গাজায় হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তির আলোচনার জন্য নেতানিয়াহুকে চাপ দেওয়া। সেই সময় জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা এটিকে 'ট্রাম্প ফ্যাক্টর' হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন, যা মার্কিন প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধোঁয়াশা রেখে দেওয়া এবং চুক্তি করার দক্ষতার প্রতি ইঙ্গিত করে। ধারণা করা হয়েছিল, এটি ক্ষমতাধর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীকে সামলানোর ক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট সুবিধা দিতে পারে। ইসরায়েলের কিছু সমালোচকও ট্রাম্পের প্রশংসা করতে শুরু করেছিলেন যে তাঁর নেতানিয়াহুর প্রভাব প্রতিহত করার সক্ষমতা রয়েছে।
কিন্তু শনিবার মার্কিন বি-২ বোমারু বিমানগুলো ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পর এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, ট্রাম্পের নিজের উপলব্ধিতে পরিবর্তন এসেছে। ইসরায়েল গত সপ্তাহে ইরানে হামলা শুরু করার পর এই প্রথম দেশটিতে হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মহলও বিদেশনীতিতে 'মাগা বিচ্ছিন্নতাবাদী' অবস্থান থেকে আরও যুদ্ধবাজ অবস্থানে চলে আসে। ট্রাম্পের যুদ্ধের প্রতি প্রকাশ্য বিতৃষ্ণা ও বিদেশে যুক্তরাষ্ট্রকে আর কোনো সংঘাতে না জড়ানোর বিষয়ে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে দেওয়া প্রতিশ্রুতি দায়িত্ব গ্রহণের ২০০ দিনের কম সময়ের মধ্যে উধাও হয়ে গেল।
দৃশ্যপটের নাটকীয় পরিবর্তন
জনসমক্ষে এসে ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েনের গুজব দূর করতে চেয়েছিলেন। তিনি এটা দেখানোরও চেষ্টা করেন যে মার্কিন নীতি ইসরায়েলের সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলছে। এর মাধ্যমে মূলত যুক্তরাষ্ট্রকে অনেকটা অন্ধকারে রেখেই যে ইসরায়েল ইরানের বিরুদ্ধে আগ্রাসী বোমা হামলা চালিয়েছে, সে ধারণা নাকচের চেষ্টা করেন ট্রাম্প। ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর ট্রাম্প বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী বিবি নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাতে চাই। আমরা এমন একটি টিম হিসেবে কাজ করেছি, যা সম্ভবত এর আগে অন্য কোনো টিম করেনি। ইসরায়েলের প্রতি এ ভয়ানক হুমকি মুছে ফেলতে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি।
ইরানের লক্ষ্যবস্তুতে ইসরায়েলের বোমা হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রথম যে প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়েছিল, সেটা থেকে ট্রাম্পের এ বক্তব্যের অনেক পার্থক্য রয়েছে। ওই সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও হামলাগুলোকে 'একতরফা' বলেছিলেন এবং বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় যুক্ত নয়। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হলো এ অঞ্চলে আমেরিকান বাহিনীকে রক্ষা করা।
মাত্র এক সপ্তাহে দৃশ্যপট সম্পূর্ণরূপে পাল্টে গেল। যুক্তরাষ্ট্রকে এখন মনে হচ্ছে, তারা ইসরায়েলি হামলাকে সম্পূর্ণরূপে সমর্থন করেছে এবং হামলায় যোগ দিয়েছে। এটি সম্ভবত এমন এক ধারাবাহিক উসকানির জন্ম দিতে পারে, যা মধ্যপ্রাচ্যকে একটি নতুন যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
ট্রাম্প প্রকাশ্যে ও ব্যক্তিগতভাবে দাবি করেছেন, ফর্দো, নাতাঞ্জ ও ইসফাহানে ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় মার্কিন হামলা ছিল এককালীন অভিযান এবং তা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন করা মার্কিন বাহিনীগুলোকে ইরানের সম্ভাব্য প্রতিশোধমূলক হামলার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ট্রাম্প তেহরানকে বলেছেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি লক্ষ্যবস্তু করা হয়, তাহলে তারা আরও হামলা চালানোর জন্য প্রস্তুত। এরপরও ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্সসহ ট্রাম্পের নিজের প্রশাসনের কর্মকর্তারা সতর্ক করে আসছেন যে তেহরান যদি পাল্টা হামলা চালায়, সেটা সীমিত হামলা হলেও তা ইরানে দীর্ঘমেয়াদি সামরিক অভিযানে রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল