স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে ওষুধশিল্প। নির্দিষ্ট কোম্পানি থেকে কাঁচামাল কিনতে হবে বেশি দামে। মেধাস্বত্ব ছাড় সুবিধা বাতিল হলে ওষুধের দাম বাড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। তাই আগাম ব্যবস্থা হিসেবে প্যাটেন্ট প্রোডাক্টগুলো অনুমোদন করে রাখার পরামর্শ দিয়েছে ওষুধশিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। নয়তো কয়েক গুণ বেশি দামে রোগীদের কিনতে হতে পারে জীবন রক্ষাকারী ওষুধ। বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব, ডেল্টা ফার্মা লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. মো. জাকির হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ওষুধ তৈরিতে ৪০০ সক্রিয় ফার্মাসিউটিক্যাল উপাদান (এপিআই) প্রয়োজন হয়। দেশের ২১টি কোম্পানি ওষুধ তৈরির ৪১ ধরনের এপিআই উৎপাদন করে। তাই ওষুধ তৈরি করতে কোম্পানিগুলোকে ৮০ শতাংশ এপিআই আমদানি করতে হয়। এলডিসি থেকে বেরিয়ে এলে এপিআই আমদানিনির্ভর হওয়ায় দেশে ওষুধের দাম কমানো ও রপ্তানির বাজার ধরা চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ড্রাগ কন্ট্রোল কমিটির অনুমোদন ছাড়া আমরা কোনো প্রোডাক্ট উৎপাদন করতে পারি না। সরকার যদি এলডিসি থেকে উত্তরণের আগে বাকি সব প্যাটেন্টের প্রোডাক্টগুলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের (ডিজিডিএ) মাধ্যমে অনুমোদন দিয়ে রাখে, তখন কোনো বহুজাতিক (মাল্টিন্যাশনাল) কোম্পানি এসে বলতে পারবে না তুমি বাংলাদেশে এটা উৎপাদন করতে পারবে না। এখন থেকেই এ পদক্ষেপ নিতে হবে। সব ওষুধের প্যাটেন্টের নিবন্ধন ২০২৬ সালের নভেম্বরের মধ্যে নিতে হবে। একই সঙ্গে দেশের কোম্পানিগুলোরও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এতে নিবন্ধিত প্যাটেন্টের প্রোডাক্ট দেশে তৈরি করা যাবে।’
ওষুধ খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় কঠিন প্রতিযোগিতায় পড়বে দেশের ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বড় মাপের প্রতিষ্ঠানগুলো কোনোরকমে টিকে থাকতে পারলেও বিপাকে পড়বেন ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারা। লোকসানে পড়ে অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। তখন ওষুধের বাজারে সংকট তৈরি হতে পারে।
হেলথকেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের সিইও মুহাম্মদ হালিমুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে ছোটবড় মিলিয়ে বর্তমানে ৩০৭টি ওষুধ কোম্পানি রয়েছে। বিশ্বের ১৫০টি বেশি দেশে রপ্তানি হয় দেশের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির ওষুধ। গত বছর ওষুধের বাজার ছিল ২ দশমিক ৯২ বিলিয়ন ডলার। আগামী পাঁচ বছরে এ বাজারের পরিমাণ দাঁড়াবে ৬ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে। রিসার্ভ ইঞ্জিনিয়ারিং পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ও ভারতের কোম্পানিগুলো ওষুধ উৎপাদন করে। মৌলিক গবেষণা করে ওষুধ উদ্ভাবন করে উৎপাদন করার মতো আর্থিক সক্ষমতা এ দেশের কোম্পানিগুলোর নেই। এজন্য বিপুল বিনিয়োগের প্রয়োজন পড়ে।’ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ট্রিপস (ট্রেড রিলেটেড আসপেক্টস অব ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) চুক্তির আওতায় প্যাটেন্ট করা ওষুধ তৈরি করতে গেলে প্যাটেন্টকারীকে বিশেষ ফি দিতে হয়। ট্রিপস চুক্তিকে মেধাস্বত্ব চুক্তিও বলা হয়ে থাকে। ১৯৯৪ সালে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে সদস্য দেশগুলোর এ চুক্তিটি এলডিসি দেশগুলোকে উৎপাদন ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়ে থাকে। ২০২৯ সাল পর্যন্ত কোনো প্যাটেন্ট ফি ছাড়াই বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এসব ওষুধ তৈরি করতে পারবে। কিন্তু এলডিসি থেকে উত্তরণের পর এ সুবিধা থাকবে না।’ ফলে প্যাটেন্ট ফি দিতে হলে ওষুধের দাম অনেক বেড়ে যাবে। এ ছাড়া বিশেষ ছাড়ে ওষুধের কাঁচামাল সংগ্রহ করার সুবিধাও থাকবে না। কাঁচামাল বেশি দামে কিনতে হবে। এসিআই হেলথকেয়ারের সিইও এম মহিবুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এলডিসির কারণে আমাদের ওষুধশিল্পে বেশ কিছু বিষয় মওকুফ করা হয়েছে। কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছালে এ ছাড়গুলো আর থাকবে না। তখন মূল (মাদার) কোম্পানি থেকে তাদের চাহিদামতো দামে এপিআই কিনতে হবে। এর প্রভাব পড়বে ওষুধের বাজারে, বেড়ে যাবে ওষুধের দাম। তাই আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে এপিআই উৎপাদনে নজর দিতে হবে।’