‘ঢাকাই চলচ্চিত্রে বিদেশি শিল্পীদের অভিনয় নিয়ে ফাঁকা আওয়াজ চলছেই। এতে দেশীয় এ শিল্পটির প্রতি দর্শক আস্থা হারাচ্ছে। এই ফাঁকা আওয়াজ থামছেই না। বছর দুয়েক আগে একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান বারবার ঘোষণা দিয়ে আসছিল তাদের ছবিতে একেক সময় অভিনয় করবেন কলকাতার নামিদামি একেক তারকা। কিন্তু অদ্যাবধি তার কোনো খবর নেই। সম্প্রতি এমন ঘটনা আবারও ঘটেছে। নির্মাতা আবু হায়াত মাহমুদ ঘোষণা দিয়েছেন তিনি শাকিব খানকে নিয়ে নির্মাণ করবেন চলচ্চিত্র ‘ওয়ান্স আপন এ টাইম ইন ঢাকা’। আর এ ছবিতে নায়িকা হিসেবে থাকবেন কলকাতার ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেত্রী মধুমিতা সরকার। ঘোষণার এক মাসের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও মধুমিতার কোনো খবর নেই। বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানিয়েছে, এ ব্যাপারে নাকি মধুমিতার সঙ্গে চলচ্চিত্রটি নিয়ে নির্মাতার কোনো আলাপই হয়নি। চলচ্চিত্র জগতের মানুষেরা বলছেন, তাহলে কি এটি ফাঁকা আওয়াজ। এমন আওয়াজ অনেক বছর ধরেই চাউর হয়েছিল। যেমন- ২০২১ সালের অক্টোবরে প্রচার হয়েছিল বাংলাদেশি অভিনেতা জায়েদ খানের সঙ্গে ‘জখম’ নামে একটি সিনেমায় অভিনয় করতে চলেছেন ওপার বাংলার নায়িকা শ্রাবন্তী চট্টোপাধ্যায়। সিনেমাটিতে নাকি অভিনয়ের জন্য ওই বছরের ১১ সেপ্টেম্বর শ্রাবন্তী চুক্তিবদ্ধ হন। ১৪ অক্টোবর থেকে ছবিটির শুটিংয়ের ঘোষণা দেয় প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। কিন্তু তার আগেই বোমা ফাটালেন শ্রাবন্তীর ম্যানেজার সুমন। তার দাবি, বাংলাদেশের নায়ক জায়েদ খানকে শ্রাবন্তী নাকি চেনেনই না। এমনকি সিনেমার প্রযোজনা সংস্থার পক্ষ থেকে শ্রাবন্তীর সঙ্গে চুক্তি হয়েছে দাবি করলেও সুমন জানিয়েছেন, কোনো চুক্তিই হয়নি। ‘জখম’ সিনেমার পরিচালক হিসেবে নাম এসেছিল অপূর্ব রানার এবং প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান শাপলা মিডিয়া। শ্রাবন্তী ছাড়াও সিনেমাটিতে ওপার বাংলার আরেক নায়িকা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত আছেন বলেও জানান নির্মাতা। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ ছবির কোনো খবর নেই। এর আগে ২০২০ সালে এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি ঘোষণা দিয়েছিল তাদের ১০টি ছবিতে অভিনয় করতে যাচ্ছেন কলকাতার সুপারস্টার দেব। দেবকে নিয়ে নির্মাণ করতে যাওয়া ছবিগুলোর নাম হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল- ‘কমান্ডো-২’, ‘কমান্ডো-৩’, ‘শেরা’, ‘সমাপ্তি’, ‘অধ্যায়’, ‘আশ্রয়’, ‘কালবেলা’, ‘খোয়াবনামা’, ‘পিলু’ ও ‘লকডাউন’। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও দেব কিংবা এসব ছবির কোনো খবর নেই। ২০২০ সালের নভেম্বরেই আবার শাপলা মিডিয়া ঘোষণা দিয়েছিল কলকাতার নায়ক দেব অভিনয় করতে যাচ্ছেন তাদের ‘মিশন সিক্সটিন’ নামের একটি ছবিতে। ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীর একটি ক্লাবে দেবের উপস্থিতিতে ছবিটির ঘোষণা দেওয়া হয়। সেই ছবিরও আজ পর্যন্ত কোনো খবর নেই। এখানেই শেষ নয়, ২০২০-এ এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি দেবকে নায়ক করে আরও একটি ছবির ঘোষণা দিয়েছিল। ছবির নাম ‘আন্ডারওয়ার্ল্ড’। এ ছবিরও এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেই। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানটি শুধু বলছে, ‘সবই হবে’। কিন্তু কখন হবে তা খোদ দেবই নাকি জানেন না। এদিকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে খবর প্রচার হয়েছিল নকশালবাড়ী আন্দোলন নিয়ে নির্মিতব্য ভারতীয় ওয়েব সিরিজে অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকীর বিপরীতে অভিনয় করবেন বাংলাদেশের অভিনেত্রী জয়া আহসান। কিন্তু নওয়াজ তখন সরাসরি জানান, ওয়েব সিরিজটিতে তিনি কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নন। পুরো খবরটাই গুজব। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নিউজ১৮-কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নওয়াজ তখন বলেছিলেন, ‘আমি কোনো ওয়েব সিরিজ করছি না। তাই ওই বিষয়টি (জয়ার সঙ্গে ওয়েব সিরিজ) পুরোটাই গুজব। আমি এমন কোনো প্রজেক্টে সাইনও করিনি। খবর চাউর হয়েছিল শাপলার ‘বিক্ষোভ’ ছবিতে প্রযোজক সেলিম খানের ছেলে শান্তর বিপরীতে দেখা যাবে কলকাতার নায়িকা শুভশ্রীকে। তাও আর হয়নি। শাপলা আরও খবর রটিয়েছিল তাদের নতুন একটি সিনেমায় অভিনয় করতে যাচ্ছে অপু বিশ্বাস। তার সঙ্গে নায়ক হিসেবে থাকছেন কলকাতার দেব। তাও আজ পর্যন্ত হয়নি। ঘোষণা শুধু ফাঁকা আওয়াজ হয়েই রয়ে গেছে। ২০২০ সালে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টিএম ফিল্মসের প্রযোজনায় নাকি শাকিব খানের বিপরীতে নার্গিস ফাখরিকে দেখা যাবে। পরে নার্গিসের ঢালিউডে পথচলা শুধুই ফাঁকা আওয়াজ হয়েই রয়ে গেছে। এর আগে বলিউডের শ্রদ্ধা কাপুরের বিপরীতে কাজ করবেন শাকিব খান। এমন একটি সংবাদ দিয়েছিল জাজ মাল্টিমিডিয়া। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আর কোনো খবর পাওয়া যায়নি। কলকাতার নায়িকা কোয়েল মল্লিকের নায়ক হচ্ছেন শাকিব খান। এ ছাড়া মাহির নায়ক কলকাতার দেব। গুগলে সার্চ করলে এমন অসংখ্য খবর পাওয়া যাবে। কয়েক বছর আগে জাজ মাল্টিমিডিয়া জানায়, তাদের আপকামিং মুভি ‘মাসুদ রানা’তে অভিনয় করবেন বলিউড অভিনেত্রী শ্রদ্ধা কাপুর। কিন্তু এ অভিনেত্রী তখন মিডিয়াকে জানান, বাংলাদেশের ছবিতে অভিনয়ের ব্যাপারে তার সঙ্গে কোনো আলাপই হয়নি। এর আগে শোনা গিয়েছিল ঢাকাই ছবিতে অভিনয় করবেন বলিউড তারকা রানী মুখার্জি। ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ নামের ছবিতে রানীর অভিনয়ের খবর যে নিছকই গুঞ্জন ছিল, তা রানী স্বয়ং উদ্বেগের সঙ্গে প্রকাশ করেন। এমন কোনো পরিকল্পনা তার নেই বলে জানিয়েছিলেন রানীর সহকারী মনিকা ভট্টাচার্য। ২০১৭ সালে বাংলাদেশি অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়ার বলিউডে অভিষেকের গুঞ্জন উঠেছিল। বিষ্ণু দত্ত পরিচালিত ‘গাওয়াহ : দ্য উইটনেস’ সিনেমায় অভিনয় করতে যাচ্ছেন তিনি। তার বিপরীতে থাকবেন বলিউডের অভিনেতা ইমরান হাশমি। ২০১৪ সালে পরিচালক রাকিবুল আলম রাকিব ঘোষণা দেন, তার পরিচালিত ‘প্রেম করব তোমার সাথে’ ছবির আইটেম গানে নাচবেন বলিউডের আনুশকা শর্মা। সিনেমাটি মুক্তির পর দেখা গেল আনুশকা নন, পারফর্ম করেছেন বাংলাদেশি আইটেম গার্ল বিপাশা কবির। এর আগে অনেক দিন ধরে শোনা যাচ্ছিল ঢাকাই চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন বলিউডের অভিনেত্রী সানি লিওন। শেষ পর্যন্ত তা গুঞ্জনই রয়ে গেল। ‘বিক্ষোভ’ নামে ছবির একটি গানে তাকে পারফর্ম করতে দেখা যাবে বলে নিশ্চিত করেছিলেন পরিচালক শামীম আহমেদ রনি। নুসরাত ফারিয়ার বিপরীতে বলিউডের ইমরান হাশমি অভিনয় করতে যাচ্ছেন বলে ঘোষণা দেয় জাজ মাল্টিমিডিয়া। ২০১৫ সালে এমন প্রচারণাকে শুধুই আওয়াজ বলেই ধরা হয়। কারণ নুসরাত ফারিয়া ‘আশিকী’ ছবিতে অভিনয় করার পর অনেক ছবিতে অভিনয় করলেও ইমরান হাশমির আর দেখা মেলেনি। ‘আশিকী’র পর ফারিয়া ও ইমরান হাশমির একসঙ্গে অভিনয়ের এমন খবর মিডিয়ার চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এ ছাড়া অনন্ত জলিল তার ‘মোস্ট ওয়েলকাম টু’ ছবির প্রচারণায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, ছবিটির আইটেম গানে পারফর্ম করবেন বলিউডের হটগার্ল বিপাশা বসু। পরে ছবিতে বিপাশার দেখা মেলেনি। একই সময়ে ২০১২ সালে অভিনেত্রী শাবানা ও তার স্বামী চিত্রপ্রযোজক ওয়াহিদ সাদিক ঘোষণা দিয়েছিলেন তারা একসঙ্গে চারটি ছবি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। এর মধ্যে দুই ছবির পরিচালকের নামও ঘোষণা করেন। তারা হলেন নার্গিস আক্তার ও শাহীন-সুমন। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী একটি ছবি হবে কলকাতার সঙ্গে যৌথ প্রযোজনার। এতে নায়িকা হিসেবে থাকবেন কলকাতার রাইমা সেন, এমন কথাও জানান ওয়াহিদ সাদিক। শেষ পর্যন্ত খবরটি ফাঁকা আওয়াজেই সীমিত হয়ে যায়। এর আগে ওয়াহিদ সাদিক ঘোষণা দিয়েছিলেন, শাকিব খান ও কোয়েল মল্লিককে জুটি করে একটি ছবি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন তিনি। কিন্তু দীর্ঘ দেড় যুগ পার হয়ে গেলেও সেই ছবি এবং কোয়েল মল্লিকের কোনো খবর নেই। আরেক অভিনেত্রী শাবনূর ২০১১ সাল থেকে ঘোষণা দিয়ে আসছিলেন তিনি ‘থ্রি ইডিয়টস’ নামে একটি ছবি নির্মাণ করতে যাচ্ছেন। এর জন্য চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সদস্যও হন তিনি। কিন্তু দীর্ঘদিন খবরটি গুঞ্জন হয়ে থাকায় একসময় পরিচালক সমিতি তার সদস্যপদ বাতিল করে। এমন আওয়াজ হরহামেশাই ওঠে। অনেক নির্মাতা যারা আসলে বোকার স্বর্গে বাস করেন এবং যাদের ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান নেই তারা এমন ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে নিজের ছবি হিট করাতে চান। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, একটি ছবি হিট বা ফ্লপ দুটিই হতে পারে এ ফাঁকা আওয়াজে। আওয়াজ দেওয়ার পর যদি ওই শিল্পী কাজ না করেন তাহলে ওই নির্মাতার ফাঁকা আওয়াজের কারণে ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। দর্শক কমে যেতে পারে ছবিটির। ছবির মান নিয়েও প্রশ্ন আসতে পারে। তাই এটা মোটেও ভালো বিষয় নয়।’ প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক সাইদুর রহমান সাইদ বলেন, ‘এক দেশের শিল্পী অন্য দেশের ছবিতে অভিনয় করে থাকেন। আর এ ক্ষেত্রে দর্শকের বাড়তি আগ্রহও থাকে। অনেক নির্মাতা এ দর্শক আগ্রহকে পুঁজি করে বিদেশি শিল্পীর মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে অহেতুক দর্শকদের প্রতারিত করার চেষ্টা করেন। এতে প্রকারান্তরে নির্মাতা নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হন। মিথ্যা বলার কারণে দর্শক তার ছবি আর দেখেন না।’ জনপ্রিয় নির্মাতা মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, ছবির প্রচারণায় ফাঁকা আওয়াজ দিয়ে লাভ নেই। এটা প্রচারণার জন্য প্রথমে সুবিধা পেলেও পরে সবাই জানার পর ছবিটি আরও বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দর গল্পের ছবি সঠিক সময়ে নির্মাণ করে দর্শকদের কাছে পৌঁছানো উচিত। ভালো নির্মাতারা সব সময়ই তাই করে থাকেন।