চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগে প্রায় সব সিনেমা কেন হিট হতো? চলচ্চিত্রকারদের কথায়- তখন প্রায় প্রতিটি সিনেমা হল মালিক নিজেরাই সিনেমা প্রযোজনা করতেন। মানে প্রদর্শকরাই ছিলেন প্রযোজক। একজন সিনেমা হল মালিক ভালো বলতে পারেন কেমন গল্প ও নির্মাণের সিনেমা দর্শক পছন্দ করেন। ফলে সহজেই ব্যবসাসফল হতো এসব সিনেমা। নব্বই দশকের শেষভাগ পর্যন্ত এ চিত্র বহাল ছিল। এরপর প্রদর্শকরা নানা কারণে সিনেমা নির্মাণের আগ্রহ হারিয়ে ফেললে সেভাবে আর কয়েক মাসেও একটি হিট সিনেমা পাওয়া যায় না। ষাটের দশক থেকে নব্বই দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত সারা দেশে প্রদর্শকদের সিনেমা প্রযোজনার চিত্র ছিল এমন- ঢাকার গুলিস্তান ও নাজ সিনেমার কর্ণধার এস এ দোসানি তার আনিস ফিল্ম করপোরেশনের মাধ্যমে প্রযোজনা করেছিলেন উর্র্দুসহ প্রায় অর্ধশত সিনেমা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো- সাত ভাই চম্পা, পায়েল, বেদের মেয়ে প্রভৃতি। ঢাকার স্টার সিনেমার মালিক ইফতেখার উল আলম তার স্টার ফিল্ম করপোরেশনের ব্যানারে নির্মাণ করেন বেহুলা, বাহানা, সঙ্গম, দুই ভাই, যোগবিয়োগ, দুই পয়সার আলতাসহ প্রায় অর্ধশত হিট সিনেমা। চাঁদপুরের চিত্রলেখা সিনেমা হলের অন্যতম একজন মালিক এম এ মোহিত তার লিবার্টি ফিল্মস করপোরেশনের ব্যানারে নির্মাণ করেন অসংখ্য সিনেমা। এর মধ্যে অন্যতম একটি হিট সিনেমা হলো- ‘পাতাল পুরীর রাজকন্যা’। ঢাকার শাবিস্তান সিনেমা হলের মালিক মোস্তফা তার ফেমাস ফিল্মস করপোরেশনের মাধ্যমে নির্মাণ করেন দর্পচূর্ণ, ভানুমতিসহ অসংখ্য দর্শকনন্দিত সিনেমা। মানসী সিনেমা হলের মালিক আহরাম আহমেদ সিদ্দিকী প্রযোজনা করেন সারেং বউ, বন্ধনসহ অসংখ্য কালজয়ী সিনেমা। লায়ন সিনেমার মালিক মির্জা আবদুল খালেক তার এন এন ফিল্মসের ব্যানারে নির্মাণ করেন অবদান, ঘরনী, লোভলালসাসহ বহু দর্শকনন্দিত সিনেমা। মধুমিতা সিনেমা হলের অন্যতম কর্ণধার ইফতেখার উদ্দীন আহমেদ নওশাদ তার মধুমিতা মুভিজের ব্যানারে নির্মাণ করেন- আগুন, নিশান, দূরদেশ, এক মুঠো ভাত, অলংকারসহ শতাধিক জনপ্রিয় সিনেমা। অভিসার সিনেমা হলের কর্ণধার সফর আলী ভূঁইয়া ও কে এম আর মঞ্জুর তাদের অভি ফিল্মসের ব্যানারে নির্মাণ করেন দাঙ্গা, সিপাহী, লালুভুলু, ননদভাবী, অ্যাকসিডেন্টসহ অনেক দর্শকপ্রিয় সিনেমা। বলাকা সিনেমা হলের কর্ণধার হাসান দাউদ নির্মাণ করেন রাজাসাহেব সিনেমাটি। শ্যামলী সিনেমা হলের মালিক আবদুল হাফিজ তার লিবার্টি প্রোডাকশনের ব্যানারে নির্মাণ করেন আসমান জমিন, বিষকন্যাসহ বেশকটি জনপ্রিয় সিনেমা। বিউটি সিনেমা হলের মালিক এস এ খালেক নির্মাণ করেন মহানগরসহ বেশকটি সফল সিনেমা। এশিয়া ও পর্বত সিনেমা হলের মালিক শাহদাত হোসেন বাদশা ও মনোয়ার হোসেন ডিপজল তাদের অমি বণি কথাচিত্রের ব্যানারে নির্মাণ করেন কোটি টাকার কাবিন, পিতার আসন, চাচ্চু, দাদীমা, মায়ের হাতে বেহেশতের চাবিসহ বেশকটি দর্শকনন্দিত সিনেমা। সনি সিনেমা হলের মালিক মোহাম্মদ হোসেন তার সনি কথাচিত্রের ব্যানারে নির্মাণ করেন জন্মদাতা, ফায়ার, আজকের হাঙ্গামাসহ বেশকটি ব্যবসাসফল সিনেমা। পদ্মা ও সুরমা সিনেমা হলের কর্ণধার এ বি সিদ্দিকী ও শফী বিক্রমপুরী তাদের যমুনা ফিল্মস করপোরেশনের ব্যানারে নির্মাণ করেন অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী, ডাকু মনসুর, সবুজ সাথী, সকাল সন্ধ্যাসহ অসংখ্য হিট সিনেমা। পূর্ণিমা সিনেমা হলের মালিক আবুল খায়ের প্রযোজনা করেন সুতরাং-এর মতো কালজয়ী সিনেমাটি। চিত্রা মহলের কর্ণধার কাজী জহির তার চিত্রা ফিল্মসের ব্যানারে নির্মাণ করেন- আশার আলো, চাষীর মেয়ে, দস্যুরানী, বধূবিদায়, ফুলের মালা, বন্ধন, রানী চৌধুরানীসহ বেশ কয়েকটি ব্যবসাসফল সিনেমা। যশোরের মনিহার সিনেমার মালিক সিরাজুল ইসলাম প্রযোজনা করেন বিসর্জনসহ বেশকটি দর্শকপ্রিয় সিনেমা। সিরাজগঞ্জের মমতাজ সিনেমা হলের মালিক শেরতাজ আলী ডাবলু নির্মাণ করেন স্পর্ধাসহ অনেক হিট সিনেমা। ফরিদপুরের চালার রজনীগন্ধা সিনেমা হলের মালিক আবদুর রাজ্জাক প্রযোজনা করেন মিথ্যার মৃত্যু। চট্টগ্রামের সানাই সিনেমা হলের মালিক পানাউল্লাহ প্রযোজনা করেন সত্যের মৃত্যু নেই ও টাকার অহংকার- এর মতো বাম্পার হিট সিনেমা। চট্টগ্রামের খুরশিদ মহল সিনেমা হলের কর্ণধার শাহেদ আজগর চৌধুরী ও রাশেদ আজগর চৌধুরী প্রযোজনা করেন পিতাপুত্র ও অভিশাপসহ বেশকটি সিনেমা। নারায়ণগঞ্জের গুলশান সিনেমা হলের মালিক মহিউদ্দীন আহমেদ প্রযোজনা করেন পুত্রবধূ ও গৃহলক্ষ্মীর মতো দর্শকপ্রিয় সিনেমা। নারায়ণগঞ্জের আশা সিনেমা হলের মালিক মণির হোসেন তার আশা ফিল্মস করপোরেশনের ব্যানারে নির্মাণ করেন অন্তরে অন্তরে, অমর, অচিন দেশের রাজকুমারসহ বেশকটি হিট সিনেমা। নারায়ণগঞ্জের ডায়মন্ড সিনেমা হলের মালিক ইফতেখার আহমেদ তার স্ক্রিন ফিল্মস করপোরেশনের ব্যানারে নির্মাণ করেন রঙিন প্রাণসজনী সিনেমাটি। ঢাকার জোনাকী সিনেমা হলটি লিজ নিয়ে পরিচালনা করেন আজিজুর রহমান বুলি ও এ কে এম জাহাঙ্গীর খান। তারা প্রযোজনা করেন- নাচের পুতুল, স্মৃতিটুকু থাক, মতিমহল, হিম্মতওয়ালী, শ্বশুরবাড়ি, শুভদা, নয়নমনিসহ অসংখ্য হিট সিনেমা। জাহাঙ্গীর খানের প্রযোজনা সংস্থার নাম ছিল আলমগীর পিকচার্স। ফরিদপুরের চালার সাথী সিনেমা হলের মালিক মিয়া আলাউদ্দীন তার মালঞ্চ কথাচিত্রের ব্যানারে প্রযোজনা করেন ভাগ্যবতী, কুসুমকলি সিনেমাগুলো। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরের ঝুমুর সিনেমা হলের মালিক সুকুমার রঞ্জন ঘোষ তার আনন্দমেলা সিনেমার ব্যানারে নির্মাণ করেন কেয়ামত থেকে কেয়ামত, স্বজন, অমরসঙ্গীসহ বেশকটি ব্যবসাসফল সিনেমা। আশুগঞ্জের কোহিনূর সিনেমা হলের কর্ণধার প্রয়াত আবদুল জলিল প্রযোজনা করেন সূর্যস্নান, ধারাপাতসহ বেশকটি আলোচিত সিনেমা।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির শীর্ষ কর্মকর্তা মিয়া আলাউদ্দীন বলেন, একসময় সিনেমা হলের মালিক অর্থাৎ প্রদর্শকরা সিনেমা নির্মাণ করতেন বলে সেসব সিনেমা সহজে দর্শক মন কাড়ত। কারণ প্রদর্শকরা জানতেন দর্শক কী ধরনের সিনেমা চায়। তাই সেই সময়টা ছিল এদেশের সিনেমার স্বর্ণযুগ। তাই এখনো যদি প্রদর্শকরা সিনেমা প্রযোজনায় এগিয়ে আসেন তাহলে আমাদের সিনেমা আবার তার সোনালি অতীত ফিরে পাবে বলে আমার বিশ্বাস।