গণতন্ত্র বাংলাদেশের জনগণের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই পাকিস্তান আমল থেকে গণতন্ত্রের কথা শুনতে শুনতে তাদের কান ঝালাপালা হয়ে গেছে। তারা পাকিস্তান আমলে ষাট দশকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ‘মৌলিক গণতন্ত্র’ দেখেছে। বাংলাদেশ আমলে সত্তর দশকে শেখ মুজিবুর রহমানের একদলীয় গণতন্ত্র ‘বাকশাল’ দেখেছে। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নিজস্ব ধরনের ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ গণতন্ত্র আছে, যার ভিত্তি গণঐক্য, অর্থনৈতিক মুক্তি, স্বনির্ভরতা অর্জন ও অগ্রগতি। কিন্তু এই ভূখন্ডে বিগত দশকগুলোতে যখনই কোনো ব্যক্তি বা দলের হাতে ক্ষমতা গেছে, তাদের প্রত্যেকের হাত থেকে গণতন্ত্র পিছলে স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়েছে। তারা এক একজন ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠেছেন এবং তাদের ফ্যাসিবাদকেও গণতন্ত্র বলে দাবি করতে লাজলজ্জার ধার ধারেননি।
অখন্ড পাকিস্তান এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করার ক্ষেত্রে সামরিক একনায়করা রাজনীতিবিদদের তুলনায় সব সময় ভাগ্যবান বলে প্রমাণিত হয়েছেন। আইয়ুব খানের ক্ষেত্রেও এর কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি। রাজনীতিবিদদের কামড়াকামড়ির সুযোগ নিয়ে তিনি খুব সহজে নিজের ক্ষমতা সংহত করেন এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল করে তার ব্যতিক্রমী ক্ষমতায় গঠন করা একটি কমিশনের তৈরি ১৯৬২ সালের সংবিধানে ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর ব্যবস্থা করেন। আইয়ুবের গণতন্ত্রে জনগণ গণতন্ত্রী ছিল না, তাদের ভোট দেওয়ার এখতিয়ার ছিল কেবল ইউনিয়ন কাউন্সিলের মেম্বার ও চেয়ারম্যানদের। সংবিধান অনুযায়ী সীমিতসংখ্যক ‘মৌলিক গণতন্ত্রী’, যারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট দিতে পারত, তারাই ছিল গণতন্ত্রী। এই সংবিধান ছিল মূলত অবৈধভাবে দখল করা তার ক্ষমতাকে বৈধতা দান ও নাক ডুবিয়ে ক্ষমতার সুবিধা ভোগ করার জন্য। তার গণতন্ত্রে জনগণ তাদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ প্রার্থীদের এবং প্রেসিডেন্ট পদে মনোনীত প্রার্থীদের ও সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভোট দিতে পারত না। আইয়ুব খানের শাসনের পুরো এক দশক ছিল ‘ওয়ান ম্যান শো।’
আইয়ুব ও ইয়াহিয়া খানের শাসন এবং শোষণের বঞ্চনা ও তিক্ততার অভিজ্ঞতার সবচেয়ে বড় শিকার ছিলেন শেখ মুজিব। তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে পর্যায়ক্রমে স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে আনেন এবং স্বাধীনতা লাভের পর তিনি বেসামরিক ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ক্ষমতাকে তার একক কর্তৃত্বে নেওয়ার জন্য যা যা করেছিলেন, দেশে দেশে সামরিক শাসকরাও ক্ষমতা গ্রহণ করার পর শেখ মুজিবতুল্য একচ্ছত্র শাসকে পরিণত হওয়ার আগে হয়তো হাজারবার ভেবেছেন। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনালগ্নেই শেখ মুজিবের ‘ওয়ান ম্যান শো’র প্রবণতা দেশকে অনিবার্যভাবেই পেছনের দিকে টানতে শুরু করেছিল। তিনি দুঃশাসনের যে বিষবৃক্ষ রোপণ করেছিলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫৩ বছর পর্যন্ত দেশের জনগণকে সেই বিষবৃক্ষের ফল গিলতে বাধ্য করা হয়েছে। শেখ মুজিব সব সময় পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তিনি ক্ষমতায় আসীন হয়ে ভোল পাল্টে একদলীয় প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে ব্যবস্থায় তিনিই সর্বেসর্বা। এটাই ছিল তার ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’! তার ‘প্রথম বিপ্লব’ কী ছিল? কিছুই না। কারণ তার ‘প্রথম বিপ্লব’-এর কথা কেউ কখনো শোনেনি। হঠাৎ এক লাফে দ্বিতীয় বিপ্লব এলো কোথা থেকে?
শেখ মুজিব যা সম্পন্ন করতে পারেননি, তা করতে উদ্যোগী হন তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি অতি কৌশলে ক্ষমতা হাতিয়ে নিয়ে তার পিতার আরাধ্য কাজগুলো সম্পন্ন করতে থাকেন- নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগের ওপর প্রতিষ্ঠা করেন তার একক কর্তৃত্ব। তার ‘আইনের শাসন’ ছিল সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করা। নির্বাচন কমিশন আর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। আল্লাহর বাণী ‘কুন ফা ইয়া কুন’ অর্থাৎ ‘হও, আর হয়ে গেল’-এর মতো নির্বাচন কমিশন শেখ হাসিনার ইশারায় তার পক্ষে ফলাফল ঘোষণা করত। ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর নির্বাচনে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটার নেই, আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছাড়া অন্য দলের প্রার্থী নেই, কিন্তু শেখ হাসিনার ‘অমর দল’ আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় ‘হয়ে গেছে’। তার ‘কুন, ফা ইয়া কুন’ কত শক্তিশালী ছিল! তার আচরিত গণতন্ত্রের ‘মানসকন্যা’ ছিলেন তিনি। তার তথাকথিত গণতন্ত্রের ইতিহাসে তার পিতারও স্থান ছিল না। তার পিতার গণতান্ত্রিক ওস্তাদ ছিলেন ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। গণতন্ত্রের এই ‘মানসপুত্র’ ও ‘মানসকন্যা’র মাঝখানে শেখ মুজিবুর রহমান উধাও বা উহ্য। অথচ তিনি বৈঠকী আলোচনা, জনসমাবেশ, সংসদীয় দলের সভা, সংসদ, সংবাদ সম্মেলন, আন্তর্জাতিক ফোরামে সর্বত্র ‘স্বাধীনতা দিয়েছেন আমার বাবা’ ছাড়া কথাই বলতেন না। দুর্ভাগ্য সেসব দেশের পুত্র-কন্যাদের, যাদের পিতারা তাদের দেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে ‘জাতির পিতা’র স্বীকৃতি লাভ করা সত্ত্বেও পুত্র-কন্যাদের মুখে তাদের পিতাদের এহেন গুণকীর্তন করেননি।
শেখ হাসিনা পিতাশ্রয়ী ক্ষমতার অধিকারী হয়ে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিশ্বরী হয়ে কার্যত দিশাহারা হয়ে গিয়েছিলেন। তিনি তার মতো গণতন্ত্র চর্চা শুরু করেছিলেন, যে গণতন্ত্রে জনগণ অনুপস্থিত, কদলি বৃক্ষতুল্য জনপ্রতিনিধি, তার কথাই আইন। তিনি যা বলবেন, যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, সেটাই ‘গণতান্ত্রিক’। তার দাবি অনুযায়ী তাকে যা খুশি করার জন্য জনগণই ‘বিপুলভাবে ম্যান্ডেট’ দিয়েছে। গণতন্ত্রের এই ‘মানসকন্যা’র ধরনের গণতন্ত্র চর্চার স্বরূপ দেখে গণতন্ত্রের আদিপিতা প্রাচীন এথেনীয় রাষ্ট্রনায়ক ও আইন প্রণেতা ‘ক্লেইসথিনিস’ (খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ ৫৭০-৫০৮ সাল) হয়তো কবরে শুয়ে বুক চাপড়িয়েছেন। তিনি তো তার নগররাষ্ট্রের জন্য এমন একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যেখানে সরকারে নাগরিকদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ছিল।
শেখ হাসিনার দানবীয় শাসনে পরিকল্পিত উপায়ে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সংবিধানকে তার হাতের খেলনায় পরিণত করা হয়েছিল। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। মানুষের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও অধিকার লঙ্ঘন করার জন্য নিয়োগ করা হয়েছিল তার দলীয় কর্মীদের দ্বারা সাজানো আইনপ্রয়োগকারী সব সংস্থা। ফলে আইনপ্রয়োগকারী সরকারি সংস্থাগুলো কার্যত তার দলের সম্প্রসারিত অস্ত্রধারী বাহিনীতে। তারা রাষ্ট্রের আইন ও বিধিবিধান কার্যকর করার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ নেতাদের নির্দেশে প্রতিপক্ষ দলের নেতা-কর্মীদের হত্যা, গুম, গ্রেপ্তার, প্রতিপক্ষের বাড়িঘর, ব্যবসা দখল ও লুণ্ঠন করার কাজে নিয়োজিত হয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী বা অঙ্গসংগঠনের দায়িত্ব পালন করেছে।
এভাবে পৃথিবীর কোনো দেশে কোনো ধরনের গণতন্ত্র, একনায়কতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, স্বৈরতন্ত্র কোনোটাই দীর্ঘজীবী হতে পারেনি। বাংলাদেশেও যে শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের রাতের অবসান ঘটবে, নিপীড়িত জনগণের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বিস্ফোরণ যে ঘটবেই তা শেখ হাসিনা কেন উপলব্ধি করতে পারেননি সেটাই বিস্ময়ের ব্যাপার! পৃথিবীর কোথায় কোনো স্বৈরাচারীর শাসন চিরস্থায়ী হয়েছে? শেখ হাসিনা ও তার অনুচররা ‘মুজিববাদ’-এর বিলয় দেখেছেন, শেখ মুজিবের স্বপ্নের দ্বিতীয় বিপ্লব ‘বাকশাল’-এর পরিণতি দেখেছেন, তবু কেন হাসিনাকে সমগ্র সংসদ দখল করতে হবে? সব নির্বাহী ক্ষমতা তাকেই আঁকড়ে রাখতে হবে এবং কেনই বা নির্বাচন এড়াতে হবে? এসব করে শেষ পর্যন্ত তিনি কী হাসিল করলেন? তিনি তার পিতার মতো বিতর্কিত হয়েছেন। ক্ষোভের আগুনে পিতার মতো তার জীবনহানির ঘটনা না ঘটলেও যা ঘটেছে তা জীবিত থেকেও মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করার চেয়ে কম নয়। কোনো উচ্চাভিলাষী সেনাদল তাকে উৎখাত করেনি, যে জনগণের ‘বিপুল ম্যান্ডেট’-এর অহংকারে তিনি প্রতিপক্ষকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতেন, সেই জনগণেরই বিপুল অংশ রাজপথে অবতীর্ণ হয়ে ‘ম্যান্ডেট’ দিয়েছে ‘শেখ হাসিনার শাসন আর নয়!’ তাই হয়েছে! ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন বিপ্লবে জীবন বাঁচাতে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছে। গত বছরের জুলাই-আগস্টে ‘কুন, ফা ইয়া কুন’ জনগণের পক্ষে কাজ করেছে। শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদকে সাফল্যের সঙ্গে নির্মূল করা এবং তার লজ্জাজনক পতন থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কী শিক্ষা গ্রহণ করার মতো কিছু লাভ করেছে? গত আগস্ট মাসে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার গত প্রায় ৯ মাসে বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তেমন উন্নতি ঘটাতে সক্ষম না হওয়ায় এবং বর্তমানে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল সরকারকে যথাযথ সহযোগিতা করার মতো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করার পরিবর্তে বরং সরকারকে বিব্রত করতে সচেষ্ট থাকায় সুযোগের সন্ধানে থাকা আওয়ামী লীগ যে নাশকতামূলক ঘটনা ঘটাতে পারে, এ আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ এ সম্পর্কে বলছেন যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের চেয়েও অধিক দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা আবশ্যক মাঠে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর। সরকার আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছে, বিএনপি তা মানতে নারাজ। কদিন আগে বিএনপির একটি প্রতিনিধিদল দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। আলোচনা শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, তারা আলোচনায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
বিএনপি বাংলাদেশে সরকার পরিচালনা করেছে ১৫ বছর। নিঃসন্দেহে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল এবং সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞ। কিন্তু বিপুল জনসমর্থন ও জনশক্তি থাকা সত্ত্বেও দলটি ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কার্যকর কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। গুম, খুন, গ্রেপ্তার, মিথ্যা মামলা বিএনপির নেতা-কর্মীদের নিত্যসঙ্গীতে পরিণত হয়েছিল। এর চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার ছিল জামায়াতে ইসলামী। তাদের প্রথম সারির প্রায় সব নেতাকে মিথ্যা অভিযোগে হত্যা করেছে শেখ হাসিনার সরকার। একটি দলকে নিশ্চিহ্ন করতে আর কোনো কিছুর প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক ময়দানে যেমন সরব ছিল, বিএনপি তেমন সক্রিয় ছিল না। যদি থাকত, তাহলে আওয়ামী লীগ সরকার এত অত্যাচার-নিপীড়ন চালিয়েও সদম্ভে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারত না। ছাত্ররা যদি মরণপণ নিয়ে মাঠ দখল না করত, অকাতরে জীবন না দিত, হাজারে হাজারে পঙ্গুত্ববরণের ঝুঁকি গ্রহণ না করত, তাহলে আওয়ামী দুঃশাসন নিঃসন্দেহে দীর্ঘতর হতো। ছাত্ররা এ ঝুঁকি নিতে পারলে রাজনৈতিক আদর্শে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ দল বিএনপি কেন সে ঝুঁকি নিতে পারেনি, সে মূল্যায়ন তাদেরই করা প্রয়োজন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি নির্বাচনমুখী রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য এক পরীক্ষার সময়। তারা কার্যত সর্বশেষ নির্বাচন করেছে ২০০৮ সালে। স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনই ছিল জনসম্পৃক্ততা ও রাজনৈতিক দলশূন্যভাবে। অতএব জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে নতুন করে শিখতে হবে নির্বাচন কী, এক ব্যক্তি এক ভোটের অর্থ কী, এমনকি কীভাবে ভোট প্রদান করে যোগ্য প্রতিনিধিকে নির্বাচন করতে হয়। নির্বাচন কমিশনকে এ ব্যাপারে প্রকৃত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করতে হবে। ধরেই নেওয়া যায় এখনো প্রশাসনের সংখ্যাগরিষ্ঠ কর্মকর্তা, বিশেষ করে যারা নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকবেন, অর্থাৎ রিটার্নিং অফিসারগণ, তারা আওয়ামী লীগ আমলেই নিয়োগপ্রাপ্ত। তাদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ জেলাসমূহের ডেপুটি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী, তারাই হবেন রিটার্নিং অফিসার। অতএব নির্বাচন কমিশনকে অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় অধিক সতর্ক ভূমিকা পালন করতে হবে রিটার্নিং অফিসার নির্বাচনে। বিএনপি যদি সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে, অর্থাৎ পতিত সরকারের জঞ্জাল পরিষ্কার করার আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠানে বাধ্য করতে চেষ্টা করে, তাহলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আশা তিরোহিত হতে থাকবে। বিএনপি কী কারণে এই বাস্তবতা অনুধাবন করতে অস্বীকার করছে, তা জনগণকে বিস্মিত করছে। বিএনপি নেতাদের কথাবার্তা ও আচরণে অন্যান্য রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের মনে ইতোমধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে যে বিএনপি কী আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে? এ সন্দেহ যদি অমূলক না হয়, তাহলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গেলেও দেশে কখনো সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র আসেনি। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের দলে গণতন্ত্র চর্চা না করায় প্রতিটি বড় দলের শীর্ষ পদে কার্যত নেতৃত্বের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ কায়েম হয়েছে। অতএব তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে সরকারপ্রধানের ক্ষেত্রে একই ধরনের ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করতে চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক প্রবণতা। আওয়ামী লীগ যা করেছে, বিএনপিও তাই করতে চেষ্টা করেছিল। আওয়ামী লীগ সব সময় ধূর্ততার রাজনীতি করেও ধূর্ততাই যথার্থ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে; কিন্তু বিএনপির ধূর্ততা অবলম্বনের চেষ্টা সূচনাতেই ভেস্তে গেছে। এখন যেহেতু একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় আসছে, অতএব সংক্ষিপ্ত পথে চটজলদি ক্ষমতায় যাওয়ার অভিলাষ থেকে বিএনপিকে সরে আসতে হবে। কারণ কাক্সিক্ষত প্রস্তুতিমূলক বিলম্ব মেনে নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে নির্বাচনি ফলাফল বিএনপির অনুকূলে আসার সম্ভাবনাই অধিক।
♦ লেখক : নিউইয়র্কপ্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক