বগুড়ায় হিমাগারে বিপুল পরিমানে আলু মজুদ আর লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে আবারো চাষে ঝুঁকে পড়েছেন চাষিরা। ফলন বেশি হওয়ায় আলুর দাম কমে যায়। দাম না থাকায় লোকসানের ভয়ে হিমাগার থেকে আর সেভাবে আলু উত্তোলন করেনি তারা। গত বছরের প্রায় ৪০ শতাংশ আলু এখনো হিমাগারে পড়ে আছে। হিমাগারে গত বছরের আলু থাকার পরেও আরও ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭৭০ হাজার মেট্রিক টন আলু ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে কৃষি বিভাগ।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, স্থানীয় এবং উচ্চ ফলনশীল মিলে ৪৮টি জাতের আলুর আবাদ হয় বগুড়ায়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আবাদ হয় এস্টারিক্স (স্থানীয়ভাবে স্টিক নামে পরিচিত) নামে উচ্চফলনশীল জাতের আলু। ২০২৪ সালে জেলায় ৫৫ হাজার ৬০ হেক্টর জমিতে ১১ লাখ ৯৯ হাজার ৯১০ টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। সেখানে চাষ হয় ৬০ হাজার ৪৩৫ হেক্টর জমিতে, যা গত বছরের তুলনায় ৫ হাজার ১৭৫ হেক্টর বেশি। সর্বশেষ ফলন পাওয়া যায় প্রায় ১৩ লাখ মেট্রিক টন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আবাদি জমি ও ফলন দুটিই বেড়ে ফলনও বৃদ্ধি পায়।
গত বছর হেক্টর প্রতি ২১ দশমিক ৬ টন আলু উৎপাদন ধরা হলেও ২৩ টন পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও কৃষি বিভাগের নজরদারিতে প্রায় ২ লাখ মেট্রিক টন বেশি উৎপাদিত হয়। ফলন বৃদ্ধির ফলে বাজারে সরবরাহ বেশি থাকায় আলুর দাম কমে গিয়ে লোকসানের মুখে পড়েন কৃষক। বিভিন্ন উপায়ে আলু সংরক্ষণ করা হলেও দাম আর বাড়েনি। আলু সংরক্ষণে হিমাগার রয়েছে জেলায় প্রায় ৪২টি। এসব হিমাগারে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টন আলু সংরক্ষণের সক্ষমতা রয়েছে। গত বছরের বিপুল পরিমানে আলু হিমাগারে রয়েছে। এখনো সব আলু হিমাগার থেকে বের হয়নি। বর্তমানে আলু খোলা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ১৮ থেকে ২৫ টাকা কেজি। জেলায় আলুর উৎপাদন বেড়েছে।
গত বছর জেলায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি আলু চাষ হয়। চলতি মৌসুমে জেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে। এ পর্যন্ত অর্জন হয়েছে ৯২৫ হেক্টর জমিতে। আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে চাষ শেষ হবে। চলতি মৌসুমে ফলন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৩ লাখ ৩৫ হাজার ৭৭০ হাজার মেট্রিক টন। বগুড়া জেলার সদর উপজেলা, শিবগঞ্জ, শাজাহানপুর, কাহালু, নন্দীগ্রামসহ বিভিন্ন উপজেলায় এখন আলু চাষে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। জেলার কিছু উপজেলায় আগাম ধান কাটার পর আলু রোপন করা হচ্ছে। অক্টোবর মাসের শেষ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত আগাম আর ডিসেম্বর পর্যন্ত মৌসুমের আলু চাষ হয়ে থাকে। এদিকে জানুয়ারীর শেষ থেকে নতুন আলু বাজারে আসবে এমন প্রত্যাশা কৃষি কর্মকর্তাদের।
বগুড়ার হিমাগার মালিকরা বলছেন, হিমাগার থেকে আলু বের না হলে হিমাগার মালিকরা ক্ষতির মুখে পড়বেন। জেলায় বেশির ভাগ হিমাগারে প্রায় ৪০ শতাংশ আলু পড়ে রয়েছে। সে আলু চাষি ও ব্যাবসায়িরা উত্তোলন করছেন না। এর মধ্যে চাষিরা আবারো আলু চাষে মাঠে নামছে। গত বছর বগুড়ায় কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করে লাভের আশা করছিলেন। সেই আশা এখন দুরাশায় পরিণত হয়েছে। আলুর দাম এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে হিমাগারের ভাড়া পরিশোধের ভয়ে হিমাগার থেকে আলু নিচ্ছেন না তাঁরা। কৃষকরা বলছেন এ বছর আলু চাষ নিয়েও নানা শঙ্কায় আছেন তাঁরা।
বগুড়ার আলু চাষিরা বলছেন, বিগত বছরের চেয়ে এবার বীজ আলুর দাম বেড়েছে। এর সাথে সার, সেচ, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়েছে। যে কারণে লাভ কম হওয়ার আশঙ্কা কৃষকদের। গত বছর উৎপাদন থেকে শুরু করে হিমাগারে রাখা পর্যন্ত প্রতি কেজি আলুতে খরচ পড়েছে ২৪ থেকে ২৬ টাকা। পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি করতে হচ্ছে ১২ থেকে ১৫ টাকায়। উৎপাদিত আলু হিমাগারে রাখা হয় লাভের আশায়। এই আলু বিক্রি করে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের আর্থিক জোগান আসে। কিন্তু এবার তো সবই লোকসান।
বগুড়া সদর উপজেলার পল্লীমঙ্গল এলাকার আলু চাষী জহুরুল ইসলাম জানান, গত বছর আলু বিক্রি করে লাভ পাওয়া যায়নি। সারা বছর আলুর দাম বাড়বে বলে আশা নিয়ে থাকলেও তবুও আলুর দাম বাড়েনি। কিন্তু জমি ফেলে না রেখে কিছু আগাম ও মৌসুমের মিলিয়ে প্রায় ৩ বিঘা জমিতে আলু চাষ করছেন। উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এছাড়া চলতি মৌসুমে বীজ আলুর দাম বেশি। সার কীটনাশক সহ শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে। আগামীতে ফলন তোলার পর ভালো দাম পাওয়া না গেলে লোকসানের মুখে আবারো পড়তে হবে।
তিনি আরও জানান, প্রতি বিঘায় ১০ মন বীজ আলু লাগে। রোপনের ৬০ দিনের মধ্যে আলু পাওয়া যায়। বিঘায় ৫০ থেকে ৬০ মন আলুর ফলন পাওয়া যায়। তবে গাছ বেশি দিন থাকলে ফলন বাড়ে।
বগুড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপসহকারি কৃষি কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম ফরিদ জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৫ হাজার ৭৫০ হেক্টর। কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের সকল ধরণের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। আবহাওয়া অনূকুলে থাকে আলুর বাম্পার ফলন হবে। কৃষকরা ভালো দাম পাবেন।
বিডি-প্রতিদিন/জামশেদ