জাতীয় ঐকমত্য কমিশন প্রস্তাবিত দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। তবে তারা জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ, দুটোতেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থা চালুর প্রস্তাব করেছে। কমিশন প্রস্তাবিত সংবিধানে ‘বহুত্ববাদ’ যুক্ত করার বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে দলটি বহুত্ববাদের স্থলে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ পুনর্বহালের সুপারিশ করেছে। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন ও দুবারের বেশি কেউ প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না, এমন প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছে দলটি। তারা জাতীয় সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পরিবর্তনে আপত্তি জানিয়েছে। ঐকমত্য কমিশন জাতীয় সংসদের মেয়াদ চার বছরের প্রস্তাব দিলেও জামায়াত চায় এ মেয়াদ পাঁচ বছরই থাকুক। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে এ মতামত তুলে ধরা হয়। সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে দিনব্যাপী আলোচনা হলেও তা শেষ হয়নি। আগামীতে আবারও তারা আলোচনায় বসবে। বৈঠকে জামায়াতের পক্ষে ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নূরুল ইসলাম বুলবুল, কেন্দ্রীয় প্রচার ও মিডিয়া সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য সাইফুল আলম খান মিলন, আইনজীবী শিশির মোহাম্মদ মনির। এ ছাড়া প্যানেল সদস্য হিসেবে অংশ নেন মহিউদ্দিন সরকার।
অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান, সফর রাজ হোসেন, সাবেক বিচারপতি এমদাদুল হক এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার। সংলাপ শেষে জামায়াত নেতা সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব ছিল সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ চার বছর হবে। আমরা এর সঙ্গে দ্বিমত জানিয়েছি। আমরা বলেছি, সংসদ ও রাষ্ট্রপতির মেয়াদ পাঁচ বছর থাকবে। তিনি আরও বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। তবে এটার আকার, আকৃতি ও প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমরা আলোচনা করছি। কনস্ট্রাকটিভ, পজিটিভ ও প্র্যাকটিক্যাল রিয়েলিস্টিক সংস্কারের জন্য জামায়াতে ইসলামী পূর্ণ সহযোগিতা করবে বলে ঐকমত্য কমিশনকে আশ্বস্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাবেক এমপি তাহের বলেন, আমরা আগেই সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্বের কথা বলেছিলাম। এ ব্যবস্থায় দল ও মার্কার ভিত্তিতে সারা দেশে একই দিনে নির্বাচন হবে। নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে দলগুলো সংসদের প্রতিনিধি মনোনয়ন দেবে। এটা হলে নির্বাচনে অনেক অনিয়ম বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে কারচুপি, টাকার খেলা, ভোটারবিহীন নির্বাচন বন্ধ হবে। জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে দুই পক্ষই একমত বলে জানান জামায়াতের এ সিনিয়র নেতা। তিনি বলেন, সাংবিধানিক কাউন্সিলের কাঠামোয় কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছি। কমিশন তা বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে সংবিধান সংশোধন, অর্থবিল পাস ও আস্থা ভোট ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সংসদ সদস্য ভোটদানের বিধান রাখার প্রস্তাব করেছি।
আলোচনা ফলপ্রসূ হচ্ছে জানিয়ে সৈয়দ তাহের বলেন, অনেক বিষয়ে আমাদের ভিতরে মতবিনিময় হয়েছে, নানা বিষয়ে ব্যাখ্যা হয়েছে। কিছু কিছু বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। তিনি আরও বলেন, বিষয়গুলো জাতীয় স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত অত্যন্ত গুরুত্ব ও মনোযোগের সঙ্গে সমস্ত সংস্কার বিবেচনা করছে। যেটা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর, আমরা সে ব্যাপারে মত দিচ্ছি, ঐকমত্য হচ্ছি। এখানে ব্যক্তি বা দল আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বাংলাদেশ, বাংলাদেশের মানুষ, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং সমৃদ্ধ শান্তিময় বাংলাদেশ আমাদের লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী কতিপয় বিষয়ে খুব দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রথমত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ব্যাপারে। আমরা কোনো রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু ভয় করি না। কারও ইন্টারফেয়ারেন্স আমাদের স্বাধীনতার প্রশ্নে স্বীকার করি না। ক্রেডিবল এবং সাসটেইনেবল ডেমোক্র্যাসির ব্যাপারে জামায়াত অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা শুধু রাষ্ট্রীয়ভাবে নয়, আমাদের দলের ভিতরে এ গণতান্ত্রিক চর্চা করি। আমাদের নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনও হয়। আমাদের নির্বাচন ক্যাম্পেইন ছাড়া, ক্যান্ডিডেট ছাড়া হয়, প্যানেল ছাড়া গোপন ব্যালটে হয়। আমরা একটি এমন নির্বাচন চাই, যেটিকে দেশের মানুষ নির্বাচন বলবে। সারা দুনিয়া নির্বাচন বলবে। আমরা সুষ্ঠু স্বচ্ছ নির্বাচনের পক্ষে। এ ব্যাপারে আমাদের কোঅপারেশন থাকবে, টু মেক ইট ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল।
কোনো অবস্থাতেই এ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়ে যায় : আলী রীয়াজ
সংস্কার প্রক্রিয়ায় সবাই একত্রে আছে জানিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, সবাই মিলেই আমরা চেষ্টাটা করছি। এটা কোনো রাজনৈতিক দলের একক বিষয় নয়। কেবল রাজনৈতিক দলের বিষয় নয়, সবার বিষয়। জাতির আকাঙ্ক্ষা ধারণ করার জন্য আমাদের চেষ্টা। আমাদের লক্ষ্য এক। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করছি। সূচনা বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। রাষ্ট্র সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগ মানুষের দীর্ঘ আকাঙ্ক্ষার ফল মন্তব্য করে আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্র সংস্কারের প্রয়োজন এবং তাগিদ রাজনৈতিক দল, জনসমাজ, ছাত্র, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এসেছে। জাতীয় সনদের বিষয়ে আলী রীয়াজ বলেন, আমরা দ্রুততার সঙ্গে একটি জাতীয় সনদে উপনীত হতে চাই। একই সঙ্গে এও স্মরণ করা দরকার, আমরা এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে আছি। আমাদের এ সুযোগ তৈরি করে দেওয়া বীর শহীদদের কাছে আমাদের ঋণ আছে। যাতে কোনো অবস্থাতেই এ সুযোগ হাতছাড়া না হয়ে যায়। যেন এ সুযোগ কেন্দ্র করে আমরা এমন এক বাংলাদেশ তৈরি করতে পারি, যেখানে কোনো অবস্থাতেই কাউকে নিপীড়নের মুখে না পড়তে হয়, বিচার বা বিচারবহির্ভূত ব্যবস্থার মধ্যে তাকে মোকাবিলা করতে না হয়। সে লক্ষ্য সামনে রেখেই আমাদের যাত্রা। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনে জামায়াত ভূমিকা রাখবে আশা করে আলী রীয়াজ বলেন, চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানে আপনাদের (জামায়াতে ইসলামী) কর্মীরা সাহসিকতার সঙ্গে অংশগ্রহণ করেছেন, প্রাণ দিয়েছেন। নেতারা কারাগারে আটক থেকেছেন, লড়াই-সংগ্রামে উপস্থিত হয়েছেন।