ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদ থেকে পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার জন্য তৈরি করা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। শোভাযাত্রার মোটিফে আগুন দেওয়ার ঘটনায় অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ। এ ছাড়া গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটিও।
চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজহারুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়, শনিবার ভোর আনুমানিক ৪টা ৫০ মিনিটে চারুকলা অনুষদের দক্ষিণ পাশের গেটসংলগ্ন স্থাপিত প্যান্ডেলের ভিতরে কে বা কারা ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে। গতকাল সকালে চারুকলা অনুষদে সরেজমিন দেখা যায়, যেখানে মোটিফ তৈরির কাজ চলছিল, সেখানে ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফটি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ‘শান্তির পায়রা’ মোটিফটিও আংশিক পুড়েছে। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর মো. ইসরাফিল বলেন, ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতিকে টার্গেট করে আগুন লাগানো হয়েছে। ওই আকৃতি পুরোটাই পুড়ে গেছে। একই সঙ্গে পায়রার অবয়বটাও পুড়ে গেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগুনটা ফজরের নামাজের সময় লাগানো হয়েছে। আমরা এর পরেই খবর পাই। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস আসতে আসতে ওটা পুরোটাই পুড়ে যায়। আগুনটা ইচ্ছে করেই লাগানো হয়েছে। তবে কে বা কারা করেছে তা জানা যায়নি। ঘটনা ঘটার পরপরই সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর, পুলিশের কর্মকর্তারা এসে উপস্থিত হন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা হচ্ছে, কীভাবে এ ঘটনা ঘটেছে।’ এ ঘটনা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ। তবে তদন্ত না হওয়ার আগে কিছু নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন তিনি। সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, সেখানে সিসিটিভি রয়েছে। আমরা এখনো ফুটেজ দেখতে পারিনি। দেখলে প্রকৃত ঘটনা জানতে পারব।’
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান গতকাল সকাল ১০টায় একটি জরুরি সভা ডাকেন। ঘটনা তদন্তের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খানকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- আইন অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ইকরামুল হক, আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক ড. মোসাদ্দেক হোসেন কামাল এবং সহকারী প্রক্টর ড. এ কে এম নূর আলম সিদ্দিকী। এ ছাড়া সহকারী প্রক্টর মো. ইসরাফিল প্রাং কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এদিকে আগুন লাগার ঘটনাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছে পুলিশ। গতকাল ভোরে আগুন লাগার পর ঘটনাস্থলে আসেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হচ্ছে এটা অ্যাক্সিডেন্টাল না। কেউ ইনটেনশনালি এটা করছে। এটুকু আমরা নিশ্চিত। এখানে চারপাশে অনেক ক্যামেরা আছে। আমরা ডিজিটাল রেকর্ডগুলো নেব, ফরেনসিক করব। ডিটেকশন করে ফেলব ইনশাআল্লাহ। এখনো বলার স্কোপ আসেনি যে, কারা করেছে। এটা এই মুহূর্তে বলা যাবে না। এটা ইনভেস্টিগেশনে বের হবে।’ গতকাল বিকালে এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করেছে ঢাবি প্রশাসন। এ বিষয়ে ওসি মো. খালিদ মনসুর বলেন, ‘ঢাবি প্রশাসনের পক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে পাওয়া সন্দেহভাজন যুবককে শনাক্ত করতে আমরা কাজ করছি।’
এ ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াতপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. মোর্শেদ হাসান খান এবং যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম ও অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকার এক বিবৃতিতে বলেন, চারুকলা অনুষদের চার দেওয়ালের ভিতরে তৈরি করা এসব প্রতিকৃতিতে আগুন দেওয়া নিছক কোনো ঘটনা নয়। এটি একটি পরিকল্পিত অগ্নিকাণ্ড। এ ঘটনায় ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার সরকারের দোসর কিংবা ঘাঁপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসরদের হাত থাকার সম্ভাবনা বেশি।
এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তারা বলেন, পয়লা বৈশাখের আনন্দ শোভাযাত্রা পালনের লক্ষ্যে তৈরিকৃত প্রতিকৃতিসহ অন্যান্য জিনিসের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা ছিল না। ফ্যাসিস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর চারুকলার শোভাযাত্রা নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক থাকা অত্যাবশ্যক ছিল। অতএব, পুরো ঘটনাটি খতিয়ে দেখা দরকার বলে মনে করি। এ সময় ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, দোষীদের চিহ্নিত করে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নিরাপত্তাব্যবস্থা আরও জোরদার করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আহ্বান জানান তারা। ‘নববর্ষের ঐকতান, ফ্যাসিবাদের অবসান’ এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে এবারের প্রধান মোটিফ ছিল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’। ২০ ফুট উচ্চতার রাক্ষসীর মতো আকৃতিটি জুলাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থনে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখাকৃতি বলেই পরিচিতি পেয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও নেটিজেনদের কাছে। এটি বানানোর সময় ‘নষ্ট করে দেওয়া হতে পারে’ বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। তাই প্রশাসনের বাড়তি সুরক্ষাব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেন তারা।
এ ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে এ বিষয়ে নিজের ফেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি পোস্ট করেন তিনি। ফেসবুক পোস্টে সংস্কৃতি উপদেষ্টা লিখেছেন, ‘হাসিনার দোসররা গতকাল ভোরে চারুকলায় ফ্যাসিবাদের মুখাবয়ব পুড়িয়ে দিয়েছে। এই দুঃসাহস যারা দেখিয়েছে সফট আওয়ামী লীগ হোক বা আওয়ামী বি টিম হোক- তাদের প্রত্যেককেই আইনের আওতায় আসতে হবে, দ্রুত।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘এই শোভাযাত্রা থামানোর চেষ্টায় আওয়ামী লীগের হয়ে যারা কাজ করছে, আমরা শুধু তাদের আইনের আওতায় আনব তা না, আমরা নিশ্চিত করতে চাই এবারের শোভাযাত্রা যেন আরও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ হয়। কালকে রাতের ঘটনার পর হাসিনার দোসররা জানিয়ে দিয়ে গেল বাংলাদেশের মানুষ এক হয়ে উৎসব করুক তারা এটা চায় না। আমরা এখন আরও বেশি ডিটারমাইন্ড এবং আরও বেশি সংখ্যায় অংশ নিব।’ উপদেষ্টা ফারুকী লেখেন, ‘গত কিছুদিন জুলাই আন্দোলনের পক্ষের অনেকেই বলেছিলেন, এবারের শোভাযাত্রা সবচেয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ভিন্ন রকমের হচ্ছে। এখানে ফ্যাসিবাদের ওই বিকট মুখ না রাখাই ভালো। আমরাও সবরকম মত নিয়েই ভাবছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মত জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কালকের ঘটনার পর এই দানবের উপস্থিতি আরও অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠল। জুলাই চলমান।’