‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচি কেন্দ্র করে রাজধানী ঢাকা যেন হয়ে উঠেছিল এক খণ্ড ফিলিস্তিন। গতকাল সকাল থেকে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকা অভিমুখে ছিল মানুষের ঢল। ‘তুমি কে, আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’ স্লোগানে মুখরিত ছিল ঢাকার রাজপথ। লাখ লাখ মানুষের মিছিলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং আশপাশের এলাকা পরিণত হয় জনসমুদ্রে। কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া মানুষের হাতে ছিল ফিলিস্তিন আর বাংলাদেশের পতাকা। মাথায় ছিল ফিলিস্তিনি রুমাল কেফিয়াহ। অনেকের হাতে ছিল প্রতীকী রক্তাক্ত মৃত শিশুর লাশ।
মিছিলে অংশ নেওয়া মানুষকে বিনামূল্যে পানি ও লেবুর শরবত দিতে দেখা গেছে অনেককে। কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র সংগঠনের সদস্য, সামাজিক সংগঠনের প্রতিনিধি এবং সচেতন সাধারণ নাগরিকরা। তাদের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড- ‘ফিলিস্তিন মুক্ত করো’, ‘গাজা রক্তে রঞ্জিত, বিশ্ব কেন নীরব’, ‘স্টপ জেনোসাইড ইন গাজা’।
তপ্ত রোদে হাঁটতে হাঁটতে হ্যান্ডমাইক কিংবা খালি গলায় ছিল ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতির স্লোগান। ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’, ‘তুমি কে আমি কে, ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন’, ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘গাজা উই আর উইথ ইউ’, ‘নেতানিয়াহুর দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে’ এসব স্লোগান দেন তারা।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে কেন্দ্র করে আশপাশের মূল সড়কগুলোতে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। মিরপুর থেকে কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, ফার্মগেট, বাংলামোটর ও শাহবাগ। এদিকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ থেকে সায়েন্সল্যাব, টিএসসি থেকে নিউমার্কেট, দোয়েল চত্বর ও ঢাকা মেডিকেল। মৎস্য ভবন থেকে পল্টন, কাকরাইল, মগবাজার এলাকাজুড়ে ছিল কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া মানুষের স্রোত। মানুষের চাপে কয়েক ঘণ্টা বন্ধ ছিল সব ধরনের যান চলাচল। কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীরা নির্বিঘ্নে এসব রাজপথে মিছিল করেছেন।
কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিরা জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কোনো কর্মসূচিকে ঘিরে এত মানুষের উপস্থিতি নিকট অতীতে তারা দেখেননি।
মঞ্চে দেশের খ্যাতনামা আলেম-ওলামা ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা -বাংলাদেশ প্রতিদিন
ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে বিক্ষোভ-প্রতিবাদের ঢেউ উঠেছে গোটা বিশ্বেই। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও ‘প্যালেস্টাইন সলিডারিটি মুভমেন্ট বাংলাদেশ’ এর ব্যানারে গতকাল এই ‘মার্চ ফর গাজা’ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মূলমঞ্চে বিকাল ৩টায় পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিক কর্মসূচি। তেলাওয়াত করেন বিখ্যাত কারি আহমদ বিন ইউসুফ।
বক্তব্যে আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা ও মতের পার্থক্য থাকতে পারে। কিন্তু স্বাধীন ফিলিস্তিন সেখানকার মানুষের অধিকার। গাজার মানুষের ওপর জুলুম বন্ধের দাবিতে আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করছি।’
ইসলামিক স্কলার ড. মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, জনতার এই মহাসমুদ্র ফিলিস্তিন ও আল আকসার প্রতি আমাদের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ভৌগোলিকভাবে আমরা তাদের থেকে দূরে থাকলেও আজকের এই বিপুল উপস্থিতি প্রমাণ করে সবার হৃদয়ে বাস করে একটি করে ফিলিস্তিন। এ সময় তিনি ‘ফ্রি ফ্রি প্যালেস্টাইন’, ‘প্যালেস্টাইন উইল বি ফ্রি’, ‘ফিলিস্তিন ফিলিস্তিন, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’, ‘আমার ভাই শহীদ কেন, জাতিসংঘ জবার চাই’, ‘ওয়ান টু থ্রি ফোর-জেনোসাইড নো মোর’ বলে স্লোগান দেন।
ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা ও শান্তি কামনায় বিকাল ৪টায় মোনাজাত পরিচালনা করেন অনুষ্ঠানের সভাপতি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব মুফতি আবদুল মালেক। মোনাজাতে অংশ নেওয়া মানুষের চোখে ছিল অশ্রু। ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলা, শিশু ও নারীদের মৃত্যু, ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজা উপত্যকার করুণ বাস্তবতা হৃদয়ে নিয়ে মানুষ ফিলিস্তিনিদের জন্য মুক্তি ও শান্তি কামনা করে। এ সময় পুরো এলাকায় কান্নার রুল পড়ে যায়।
কর্মসূচিতে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), হেফাজতে ইসলামসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, বিভিন্ন সংগঠন, ইসলামি বক্তা ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা অংশ নিয়েছেন। ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান।
বিএনপির পক্ষ থেকে মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, বিএনপি চেয়ারপাসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি মওলানা রফিকুল ইসলাম খান, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ ফয়জুল করীম ও প্রেসিডিয়াম সদস্য মোসাদ্দেক বিল্লাহ আল মাদানি, খেলাফত মজলিশের আমির মাওলানা মামুনুল হক, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর ও সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান, জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, নিরাপদ সড়ক চাই-নিসচার প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামি বক্তা মিজানুর রহমান আজহারী, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান শায়খ আহমাদুল্লাহ, শিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম, কেন্দ্রীয় নেতা সাদিক কায়েম, অ্যাক্টিভিস্ট সাইমুম সাদি, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন রাজী প্রমুখ।