মা বা ভাবি চরিত্র ছাড়া চলচ্চিত্র কিংবা নাটকের গল্প প্রায়ই পূর্ণতা পায় না। বহু সিনেমা নির্মাণ হয়েছে মাকে নিয়েই। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ও নাটকে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেছেন অনেকেই। এদের মধ্যে রয়েছেন এক সময়ের তুমুল জনপ্রিয় নায়িকারাও। তাঁদের কথা তুলে ধরেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ
সুমিতা দেবী : বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসে সুমিতা দেবীকে বলা হয়- ‘ফার্স্ট লেডি’। ক্যারিয়ারের শুরুতে তাঁকে নায়িকা হিসেবে দেখা গেলেও সত্তর দশক থেকে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় শুরু করেন। মা হিসেবে খান আতাউর রহমানের ‘সুজন সখী’ ছবিতে অভিনয় করে তিনি দারুণ প্রশংসা কুড়িয়েছেন। নব্বই দশকে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
রানী সরকার : ষাটের দশক থেকে আশির দশক বাংলা চলচ্চিত্রে নিয়মিত মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন রানী সরকার। কোমলময়ী কিংবা রাগী সব চরিত্রেই তিনি অসাধারণ ছিলেন। ২০১৮ সালে তিনি মারা যান।
রওশন জামিল : সত্তর ও আশির দশকে জনপ্রিয় ও শক্তিশালী মা হলেন রওশন জামিল। অসংখ্য চলচ্চিত্রে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনি। অনেকটা কড়া মায়ের চরিত্রে অভিনয় করলেও দর্শকদের প্রিয় মুখ হয়ে ওঠেন জাতীয় পুরস্কারজয়ী এ অভিনেত্রী।
জাহানারা আহমেদ : ষাটের দশক থেকে ছোট পর্দা ও বেতারে অভিনয় করছেন এ জনপ্রিয় অভিনেত্রী। সত্তর দশকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেনের ঈদ নাটক ‘জব্বার আলী’তে সুবর্ণা মুস্তাফার মা ও আমজাদ হোসেনের স্ত্রীর চরিত্রে অভিনয় করে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান তিনি। একুশে পদকপ্রাপ্ত এ অভিনেত্রী এখন অভিনয়ে তেমন একটা নিয়মিত নন।
দিলারা জামান : বড় ও ছোট পর্দার জনপ্রিয় মা দিলারা জামান। ছোট পর্দায় হুমায়ূন আহমেদের ‘এইসব দিনরাত্রি’ ধারাবাহিকে যেমন ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান তেমনি ‘চন্দ্রগ্রহণ’ ছবিতে অভিনয় করে লাভ করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তাঁর অভিনীত আরেকটি উল্লেখযোগ্য ছবি হলো- ‘মনপুরা’। এখনো সমান দর্শকপ্রিয়তায় ছোট ও বড় পর্দায় অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি।
রোজী আফসারী : রোজী আফসারীকে বলা হয় বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে মায়াবী চেহারার মা। সত্তর ও আশির দশকে বহু ছবিতে রোজী আফসারী মায়ের চরিত্রে অভিনয় করে দারুণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ভাবির চরিত্রেও অনবদ্য অভিনয় করেন তিনি। ২০০৫ সালে মারা যান এ গুণী অভিনেত্রী।
মায়া হাজারিকা : বাংলা চলচ্চিত্রের চিরাচরিত মা তিনি নন, বেশ অহংকরী ও খলচরিত্রের মা হিসেবেই তাঁকে পর্দায় দেখা যেত। সন্তানদের ভালোবাসায় তিনি বাধা হয়ে দাঁড়াতেন। তিনি সীমানা পেরিয়ে, অনুরাগসহ অনেক ছবিতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। ১৯৯৪ সালে মারা যান তিনি।
আয়শা আখতার : বাংলা চলচ্চিত্রের নির্ভেজাল মা ছিলেন তিনি। দুঃখ-কষ্টেও তাঁর হাসিমুখ ছিল চির অমলিন। আশির দশকে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যতম জনপ্রিয় মা। ২০০৩ সালে মারা যান তিনি।
আনোয়ারা : বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি ছবিতে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করা অভিনেত্রী হলেন আনোয়ারা। সেই হিসেবে তাঁকেই বাংলাদেশের ছবিতে সবচেয়ে জনপ্রিয় মা বলে গণ্য করা হয়। আটবার জাতীয় পুরস্কার জয় করেন তিনি। বয়স ও রোগের কারণে অভিনয় থেকে দূরে আছেন এখন।
মিনু রহমান : আশির দশকে বাণিজ্যিক ছবিতে এবং টিভি নাটকে তিনি ছিলেন প্রায় নিয়মিত। সেই সময়ের সব বড় তারকাদের মা হয়েছেন তিনি। কোমলমতি কিংবা বদমেজাজি সব চরিত্রেই অভিনয় করেছেন তিনি। নব্বই দশকে মারা যান তিনি।
শবনম : শবনম নায়িকা হিসেবে চলচ্চিত্রে এলেও পরে তিনি মা হিসেবেও সফল হন। ‘আম্মাজান’ ছবিতে অভিনয় করে দারুণ আলোচিত হন তিনি। এ ছাড়া আরও অনেক ছবিতে তিনি মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন। বর্তমানে অভিনয় থেকে দূরে আছেন শবনম।
শাবানা : বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা শাবানা, মা হিসেবেও পর্দায় ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মায়ের আবেগময়ী ভূমিকায় শাবানা ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ১১ বার জাতীয় পুরস্কারজয়ী এ অভিনেত্রী বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাস জীবনযাপন করছেন।
ডলি জহুর : শুরুতে টেলিভিশন অভিনেত্রী থাকলেও পরে চলচ্চিত্রেও মা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন ডলি জহুর। ‘এইসব দিনরাত্রি’ নাটকে টুনির মা চরিত্রে অভিনয় করে বিপুল প্রশংসা অর্জন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি হয়ে ওঠেন নব্বই-পরবর্তী সবচেয়ে জনপ্রিয় মা। জাতীয় পুরস্কারজয়ী এ অভিনেত্রী বর্তমানেও অভিনয় করে যাচ্ছেন।
খালেদা আক্তার কল্পনা : অভিনয়ের কারণে একসময় শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দেন তিনি। তাঁর অভিনীত প্রায় পাঁচ শতাধিক চলচ্চিত্রে নায়ক রুবেলের মায়ের চরিত্রে বেশি দেখা গেছে তাঁকে। জাতীয় পুরস্কারজয়ী এ অভিনেত্রী অসুস্থতার কারণে এখন অভিনয়ে আর নিয়মিত নন।
শর্মিলী আহমেদ : চলচ্চিত্রে প্রথমে তিনি অভিনয় করেছেন নায়িকা চরিত্রে। প্রথম মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন ১৯৭৬ সালে ‘আগুন’ ছবিতে। এ ছবিতে দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করা রাজ্জাক তাঁর স্বামী ও ছেলের অভিনয় করেন। তারপর মমতাময়ী মায়ের রূপে নিয়মিত টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে হাজির হয়েছেন শর্মিলী আহমেদ। বছর দুয়েক আগে তিনি পরলোক গমন করেন।
সুচরিতা : বাংলা চলচ্চিত্রের ড্রিমগার্ল খ্যাত জনপ্রিয় নায়িকা সুচরিতা নব্বইয়ের শেষে এসে মায়ের ভূমিকায় নিয়মিত অভিনয় করা শুরু করেন। জাতীয় পুরস্কারজয়ী সুচরিতা, চাষী নজরুল ইসলামের ‘হাঙ্গর নদী গ্রেনেড’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয় করেছিলেন। বর্তমানে তাঁকে অভিনয়ে আর নিয়মিত দেখা যায় না।
ববিতা : ববিতা নায়িকা হিসেবে বেশ সফল। সাতবার জাতীয় পুরস্কারজয়ী এ অভিনেত্রী নব্বইয়ের মাঝামাঝি এসে নিয়মিত মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা শুরু করেন। ২০১৫ সালে ‘পুত্র যখন পয়সাওয়ালা’ ছবিতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করার পর চলচ্চিত্র জগৎ থেকে বিদায় নেন তিনি।
রাশেদা চৌধুরী : নব্বই দশকের শেষে এসে বাংলা চলচ্চিত্র মায়ের চরিত্রে আবিষ্কার করে রাশেদা চৌধুরীকে। এ অভিনেত্রীর আলোচিত ছবিগুলোর মধ্যে- ম্যাডাম ফুলি, ভেজা বেড়াল, টাকা, ক্ষুদে যোদ্ধা, কাল সকালে, চার সতীনের ঘর অন্যতম। বর্তমানে অভিনয়ে নিয়মিত নন তিনি।
এ ছাড়া রিনা খান, সুলতানা জামান, মিরানা জামান, সুষমা, রিনা আক্রাম, মালতী দেবী, মিনতি হোসেন, সুজাতা, শারমিন, রেহানা জলি, মিলি বাশার, আন্না, রেবেকাসহ অনেক অভিনেত্রী মা ও ভাবির চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন।