যেখানে যাই সেখানেই মানুষের কাছ থেকে প্রশ্ন আসে- নির্বাচন কবে হবে? দেশের মানুষ নির্বাচনের জন্য উন্মুখ বছরের পর বছর ধরে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতার পাশাপাশি সর্বস্তরের মানুষ রাজপথে নেমেছিল গণতন্ত্রহীনতার অপমান থেকে রক্ষা পেতে। শেখ হাসিনা বা আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের পর দীর্ঘ আট মাস কেটে গেলেও নির্বাচন নিয়ে ধোঁয়াশা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি নির্বাচন বিষয়ে স্পষ্ট হতে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে বিএনপির একটি উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীর আশা ছিল, এ বৈঠকে নির্বাচন সম্পর্কিত সুস্পষ্ট রোডম্যাপ পাওয়া যাবে। এ নিয়ে জনমনে যে প্রশ্ন রয়েছে তার সদুত্তর মিলবে।
বিএনপির সাত সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদল রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হয়েছিলেন সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিএনপি যৌক্তিক কারণেই নিজেদের সরকার বলে মনে করে। কারণ বিএনপিসহ স্বৈরশাসনবিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের ফসল এ অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু বৈঠক শেষে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলতে বাধ্য হয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারেনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি। বিএনপির প্রতিনিধিদল সরকারপ্রধানের কাছে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সুস্পষ্ট তারিখ জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে কোনো ডেডলাইন দেননি প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বরাবরের মতোই ডিসেম্বর থেকে জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে সাফ সাফ বলে দেওয়া হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে তারা নির্বাচন চান।
বিএনপির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বসা হয়েছিল আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে। নিছক চা পান বা খোশগল্পের জন্য নয়। কবে নির্বাচন হবে সে ডেডলাইন সম্পর্কে অবহিত হওয়াও ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা কথামালা দিয়েই বিএনপি প্রতিনিধিদলকে বিদায় করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা বলেননি, ডিসেম্বরে ভোট হবে না। বলেছেন, ডিসেম্বর থেকে ছাব্বিশের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যেই ভোট হতে হবে। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা না দেওয়ায় বিএনপি যে অসন্তুষ্ট সেটিও স্পষ্ট করা হয়েছে সাংবাদিকদের কাছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের জাঁতাকলে দীর্ঘ পৌনে ১৬ বছর নিষ্পেষিত হয়েছে বিএনপি। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দল হিসেবে তারা ডিসেম্বরে নির্বাচন চাওয়ার পাশাপাশি এ নিয়ে রোডম্যাপ চেয়ে আসছিল।
কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ নীতি অবলম্বন করা হচ্ছিল। প্রথমে বলা হচ্ছিল ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হবে। পরে বলা হলো কম সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরে আর বেশি সংস্কার চাইলে ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। হঠাৎ করে কোনো কোনো উপদেষ্টার পাখা গজাতে শুরু করল। এদের একজন বলে বসলেন, জনগণ নাকি তাদের পাঁচ বছর ক্ষমতায় দেখতে চায়। আরেকজন দাবি করলেন, এ সরকার নাকি অনির্বাচিত নয়। সোজা কথায় অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টার আচরণে জনমনে যে সন্দেহ দানা বেঁধে উঠছে তা প্রত্যাশিত ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে সরকারের অবস্থান জানতে ১৬ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে যান বিএনপির শীর্ষস্থানীয় আটজন নেতা। প্রতিনিধিদলে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে কোনো সুস্পষ্ট জবাব পাওয়া যায়নি। বিএনপি মহাসচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তাঁর কাছে ‘দেশে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দ্রুত করণীয় কিছু বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ’ শীর্ষক এ চিঠি হস্তান্তর করেন।
চিঠিতে বিএনপি উল্লেখ করে, দীর্ঘ ১৬ বছরের লড়াইয়ে ১৭০০-এর বেশি বিরোধী নেতা-কর্মী গুম, সহস্রাধিক খুন এবং ৬০ লাখের বেশি নেতা-কর্মী আহত, পঙ্গু ও গায়েবি মামলায় হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ ছাড়া ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানে ২ সহস্রাধিক তরুণ, ছাত্র, শ্রমিক ও নারী-শিশু জীবন উৎসর্গ করেছেন এবং আরও কয়েক হাজার আহত ও পঙ্গু হয়েছেন। ফ্যাসিবাদের পতন এবং গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লড়াইকে অসীম আত্মত্যাগ ও সাহসী লড়াইয়ের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস বলে অভিহিত করেছে বিএনপি।
চিঠিতে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রতিটি লড়াইয়ের নেতৃত্বদানকারী বা সক্রিয় অংশীদার হিসেবে বিএনপি সর্বদা জনগণের কল্যাণে কাজ করে এসেছে। সেই লক্ষ্যে বিএনপি ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের সুফল জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এবং তাদের আকাক্সক্ষা পূরণে একটি টেকসই ক্ষেত্র তৈরির জন্য সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনার ভার গ্রহণে অধ্যাপক ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থন জানিয়েছে এবং পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে ও সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছে। বিএনপি আশা প্রকাশ করে, অধ্যাপক ইউনূস ও তাঁর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জনগণের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা হলো- দ্রুত ফ্যাসিবাদী দল, তাদের দলীয় সরকার ও সহযোগীদের আইনের আওতায় এনে গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা, নিহত ও আহতদের ক্ষতিপূরণ ও সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা, দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলার উন্নতি ঘটানো এবং দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া।
বিএনপি গণতন্ত্রের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ দল। স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এ দলের প্রতিষ্ঠাতা। বাকশালী শাসনের অবসান ঘটিয়ে তিনি দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এরশাদের সেনা-শাসনের বিরুদ্ধে গণ অভ্যুত্থান গড়ে তুলতে নেতৃত্ব দিয়েছে বিএনপি। নির্যাতিত হয়েছে কিন্তু তারা স্বৈরাচারের সঙ্গে আপস করেনি। ওয়ান-ইলেভেনের অবৈধ শাসকরা বিএনপির ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে তা শিউরে ওঠার মতো। বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে কারাগারে ভরা হয়েছে মিথ্যা অভিযোগে। শহীদ জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমানের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয়েছে। তাঁকে পঙ্গু করার ষড়যন্ত্র চলেছে। তারপরও বিএনপিকে মাথানত করানো যায়নি। আওয়ামী দুঃশাসনের পৌনে ষোল বছরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলা ও হামলার নির্মম শিকার হয়েছেন শহীদ জিয়ার শিষ্যরা। কিন্তু তারা মাথানত করেননি। এ সময়ে বিএনপিতে ভাঙন ধরানোর চেষ্টা চলেছে। দলীয় নিবেদিতপ্রাণ কর্মীরা তা রুখে দিয়েছেন। মুনাফিকদের মতো বিএনপি বা অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ছাত্রলীগ সেজে তস্কর বৃত্তিতে জড়িত হয়নি।
বিএনপি দেশ পরিচালনায় জনগণকেই অথরিটি মনে করে। কীভাবে দেশ চলবে তা দেশের মালিক মোক্তার জনগণই নির্ধারণ করবে। এ কারণে বিএনপি দ্রুত নির্বাচন চায়। সংস্কার কিংবা অন্য কোনো অজুহাতে নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা হলে জনগণ তা মেনে নেবে না।
হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিছু রাজনৈতিক দল আবিষ্কার করছে বিএনপি নাকি সংস্কার চায় না। অথচ বিএনপির আত্মপ্রকাশ সংস্কারের লক্ষ্য নিয়ে। দেশে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে বিএনপি শহীদ জিয়ার নেতৃত্বে। দেশের কৃষিব্যবস্থার সংস্কারে শহীদ জিয়া যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা ছিল সুদূরপ্রসারী। দেশের রাজনৈতিক সংস্কারের কৃতিত্বও তাঁর পাওনা। বাংলাদেশ থেকে জনশক্তি রপ্তানি শুরু হয় বিএনপি আমলেই। আর তাই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, পত্রপত্রিকা খুললেই সংস্কার আর সংস্কার। সংস্কার শুরু করেছে বিএনপি। শহীদ জিয়া প্রথম সংস্কার শুরু করেন খাল খননের মধ্য দিয়ে। বিএনপি যদি জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসে তাহলে বাংলাদেশের সব খাল খনন করে জীবিত করা হবে। প্রথম কাজ হবে খাল খনন কর্মসূচি। রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের লক্ষ্যে দেশের জনগণের স্বার্থে ৩১ দফা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
এর মধ্য দিয়েই বাংলাদেশে শান্তি ফিরে আসবে। সব সেক্টর দুর্নীতিমুক্ত হবে। দেশে থাকবে না একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। আর সে জন্যই আগে দরকার নির্বাচন। এটি আজ সবচেয়ে বড় জনদাবি।
লেখক : যুগ্ম মহাসচিব, বিএনপি। সাবেক সংসদ সদস্য ও ডাকসুর জিএস